.
এক
.
লুই ফার্দিনাঁ সেলিন সম্পর্কে তাঁর জীবনীকার মার্লিন টমাস লিখেছেন, “ব্যাপক অর্থে তিনি ছিলেন একজন কবি। তিনি আমাদের শতকের অমানবিক ঘটনাবলীর একজন সাক্ষীও ছিলেন। সেলিনের পাঠবস্তু হলো ‘যুদ্ধ, মৃত্যু এবং যৌনতা’ কিন্তু সেগুলো কেবল তাঁর পাঠবস্তু; প্রকৃতপক্ষে তাঁর বিষয় হলো ঘৃণা। বিশেষ করে, মানুষের অবস্থার প্রতি ঘৃণা ।” ১৯৪৯ সালে, সেলিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তিনি "শতাব্দীর সবচেয়ে অভিশপ্ত লেখক ঘোষিত হবেন।" আবার, ১৯৬১ সালে, সেলিন একটি কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন: "আমি জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে বড় জারজ!” অবশ্য চার্লস বুকোস্কি বলেছিলেন সেলিন "২০০০ বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক" । সেলিন ছিলেন একজন সাহিত্যিক প্রতিভা, এবং তাঁর আটপৌরে ফরাসি বুলির ব্যবহার (তাঁর সময়ের মার্সেল প্রুস্ত-উপাসক প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ), উপবৃত্তের অবাধ প্রয়োগ বিশ শতকের সবচেয়ে স্বতন্ত্র সাহিত্য শৈলীগুলির একটি তৈরি করতে সফল হয়েছিল।
.
প্যাসকেল ইফরি লুই-ফার্দিনান্দ সেলিনের জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট (১৯৩৪ এবং ১৯৮৮)-এর দুটি ইংরেজি অনুবাদের তুলনা করেছেন - সেলিন তাঁর স্বাতন্ত্র্যসূচক লেখার শৈলীকে 'যৎসামান্য সঙ্গীত' বলে অভিহিত করেছিলেন আর তাঁর প্রথম অনুবাদক জন মার্কসকে তাঁর অত্যন্ত প্রভাবশালী উপন্যাসের প্রাথমিক সংস্করণের গদ্যের 'নাচের' ছন্দের মতন ধারণা প্রকাশ করার চেষ্টা করতে উৎসাহিত করেছিলেন, যা মার্কস একেবারেই করেননি, বা পারেননি, যা তাঁর অনুবাদ থেকে স্পষ্ট। যাইহোক, রাল্ফ ম্যানহেইমের দ্বিতীয় অনুবাদটি পাঠ্যের মূল শৈলীর প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়েছে। ম্যানহেইমকে মার্কসের করা অনেক ভুল সংশোধন করতে হয়েছিল এবং মার্কসের ব্রিটিশ ইংরেজিকে আমেরিকানাইজ করে সেলিনের কাজের চেতনার সাথে তাল মিলিয়ে বইটিকে অনুবাদ করতে হয়েছিল ।
.
ব্রিটেনের সেন্সরশিপ - রক্ষণশীল সমাজের সরল লজ্জা - মার্কসের জন্য সমস্যা ছিল, যেমন, 'শিট', 'হতাশাগ্রস্ত গুদ’', ‘অ্যাঁড়’ এমনকি সৈন্যদের ‘হাত মারা’ সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছিলেন মার্কস। সেলিনের তিনটে ফুটকি বা এলিপসিস প্রয়োগের গুরুত্ব বুঝতে না পেরে তিনি বহু জায়গায় সেগুলো বাদ দিয়েছিলেন। ম্যানহেইমের পুনরুদ্ধারের কাজের দরুন সেলিনের ফরাসি কেমন করে পড়া উচিত সে সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা হয়, তবে অনুবাদ অবশ্যই সবসময় সমস্যা তৈরি করে। এর সাথে যোগ করতে হয় বিশেষ অসুবিধা যা এই জাতীয় মৌলিক এবং যুগান্তকারী কাজের অনুবাদে অবশ্যই আনতে হয় ।
.
পাসকাল ইফরি স্পষ্টতই এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয়েছেন যে ম্যানহেইমের অনুবাদটাও আদর্শ নয়, কিন্তু... কিন্তু ৫৪ বছর ধরে ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’-এর অনুবাদ যাঁরা ইংরেজিতে পড়েছেন বা জন মার্কসের ইংরেজি থেকে নিজের ভাষায় অনুবাদ করেছেন, তাঁদের ৫৪ বছর ধরে নিকৃষ্ট এক সংস্করণকে সেলিনের উপন্যাসের গদ্য বলে মেনে নিতে হয়েছিল। তাহলে কীভাবে সেলিন মার্কিন লেখক ও বিট আন্দোলনের ওপর এমন প্রভাব ফেলেছিলেন, যাদের বেশিরভাগই জন মার্কসের অনুবাদ পড়েছেন এবং সেলিন নয়? পাসকাল ইফরির মতে সেলিনের 'বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি' লেখকদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর লেখার শৈলী নয়। সেলিনকে সম্ভবত কেউ নালিশও করেনি যে মার্কসের অনুবাদে ‘জার্নি টু দি এন্ড অফ দি নাইট’ অনুপস্হিত।
.
দুই
.
লুইস ফার্দিনাঁ সেলিন, যাঁর পিতৃদত্ত নাম লুইস-ফার্দিনাঁ দেসতুশ, জন্মেছিলেন ১৮৮৪ সালে ফ্রান্সের কোরবিভয়েতে । ১৮৮৪ সালে প্যারিসের শহরতলিতে জন্মগ্রহণকারী সেলিন ছিলেন একমাত্র সন্তান। তাঁর মা তাঁদের ফ্ল্যাটের একতলায় একটা অন্তর্বাসের দোকানের মালিক ছিলেন, আর তাঁর বাবা বীমা কোম্পানিতে কেরানির কাজ করতেন । অন্তর্বাসের দোকানটা ১৮৯৭ সালে লাটে উঠে যাবার পর ১৮৯৯ সাল নাগাদ তাঁরা প্যারিসে চলে যান আর দ্রুত অবস্হা ফেরানোর চেষ্টা করেন । তরুণ সেলিনের জীবন কষ্টকর ছিল না। স্কুলের রিপোর্ট কার্ডগুলো তরুণ লুইকে বুদ্ধিমান কিন্তু অলস শিশু হিসেবে বর্ণনা করে। একটি স্কুলের প্রতিবেদনে তাঁর বাবা-মায়ের "দুর্বলতা"কে তাঁদের সন্তানের বিকাশের প্রতিবন্ধক হিসেবে সমালোচনা করা হয়েছে। তাঁকে পরপর একটা স্কুল থেকে বের করে অন্য স্কুলে ভর্তি করানো হতো, অথচ কোন আপাত কারণ ছাড়াই তাঁকে আবার আগের স্কুলে ভর্তি করা হতো।
.
লুইয়ের মা, মার্গুরাইত গুইলো, একজন শীতল আর অমিশুকে ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এটা তাঁর মাতামহী, সেলিন গুইলো, যিনি লুইকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন, তাঁর অবদান। লুই পরে নিজের পরিচয় ঢাকতে দেশতুশ পদবি বাদ দিয়ে সাহিত্যিক হিসাবে সেলিন নামটা নিয়েছিলেন। লুইয়ের বাবা ফার্নান্দও ছিলেন একজন জটিল চরিত্রের মানুষ। যে বছর ক্যাপ্টেন আলফ্রেড দেফ্রুজকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, লুই ফার্দিনাঁ সেলিন সেই বছর জন্মান । ক্যাপ্টেন দ্রেফুজ সম্পর্কে ফরাসি ক্যাথলিকরা এমন গল্প তৈরি করেছিল যা ফরাসি জাতিকে বিভক্ত করে ইহুদি বিদ্বেষের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফার্নান্দও বিশ্বাস করতেন যে দ্রেফুজ লোকটা বিশ্বাসঘাতক।
.
ক্যাপ্টেন আলফ্রেড দ্রেফুজ ছিলেন ফরাসি সেনাবাহিনীতে কর্মরত উদ্ধত আর্টিলারি অফিসার। ধর্মে ইহুদি। ইহুদি-বিরোধী ফরাসি সেনাবাহিনীতে যাদের যোগদান ছিল নিতান্তই নগন্য। সামান্য যে কয়জন ইহুদি সেনাবহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে পদমর্যাদায় ও সাহসীকতায় দ্রেফুজই ছিলেন অন্যতম। আর সে কারণে ইহুদি-বিদ্বেষী সেনা অফিসারদের প্রতিহিংসার শিকার হন দ্রেফুজ। ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বন্ধ ঘরে সাতজন বিচারকের সামনে আলফ্রেড দ্রেফুজের কোর্ট-মার্শাল হবার সময় জাল সাক্ষ্য প্রমাণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন বিচারকরা। শেষ অবধি দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড । প্রকাশ্যে দ্রেফুজের সামরিক পোশাক খুলে নিয়ে কেড়ে নেয়া হয় সামরিক বাহিনীতে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাওয়া সব পদক। সেনারা তাঁর তলোয়ার ভেঙে ফেলে। তাঁর অধস্তন সৈন্যদের সামনে দ্রেফুজকে কয়েক মাইল দৌড় করানো হয়। দৌড়ানোর সময় সৈন্যরা ইচ্ছেমতো তাঁকে পিটতে আর যথেচ্ছভাবে গালিগালাজ করতে থাকে। তাঁর এক সময়ের সহকর্মী অফিসাররা তাঁর গায়ে থুথু ছোঁড়ে। এরপর জাহাজে করে দ্রেফুজকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুখ্যাত ‘শয়তানের দ্বীপ’ বা ‘ডেভিলস আইল্যান্ড’-এ। ঘটনা এখানেই থেমে যেতো, ফরাসি জনগণ আর পাঁচটা বিচারের মতো এটিও হয়তো ভুলে যেতো যদি না সাহিত্যিক এমিল জোলা এই রায় নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করতেন। সরকারকে খোঁচা দিয়ে মানহানির এমন একটা মামলায় নামতে সরকারকে বাধ্য করলেন জোলা, যাতে দ্রেফুজের বিচার আবার নতুন করে শুরু হয়। জোলা ‘লা অরোরে’ পত্রিকায় ফরাসি প্রেসিডেন্টকে রীতিমতো একটা খোঁচা-মারা চিঠি প্রকাশ করলেন। ‘অপরাধী’ শিরোনামে, বড়-বড় অক্ষরে চিঠিটি ছাপাও হলো। ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধানকে বিদ্রুপ করার কারণে জোলার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয়। রায়ে জেলের সাজা দেয়া হলে জোলা ফ্রান্স থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন। কিন্তু এর মধ্যেই জোলার চিঠির প্রভাব হল ব্যাপক। সমাজের এক শ্রেণী, সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা, ক্যাথলিক চার্চের ধর্মগুরু থেকে শুরু করে সমাজের পৃষ্ঠপোষকরা, সেনাবাহিনীর পক্ষে সমর্থন দিতে থাকে। আবার উল্টোদিকে, সমাজতন্ত্রী ও উদারপন্থী লোকজন ও বুদ্ধিজীবীরা দ্রেফুজের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। ফলে সরকার নতুন করে দ্রেফুজের মামলা শুরু করতে বাধ্য হলো। ডেভিলস আইল্যান্ড থেকে ফিরিয়ে আনা হলো দ্রেফুজকে। তাঁর সেই শক্তপোক্ত, গর্বোদ্ধত চেহারা তখন আর নেই। চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে, শরীর প্রায় কঙ্কালসার। দ্রেফুজের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় । দ্রেফুজ মামলা ফরাসি লেখকদের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। অর্ধ-ইহুদি, মার্সেল প্রুস্ত, দ্রেফুজের পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য আনাতোল ফ্রাঁসেকে অনুরোধ করেছিলেন ।
.
এই রাজনৈতিক ঘটনা বালক লুই ফার্দিনাঁ সেলিনের মনে এমন প্রভাব ফেলেছিল যে তিনি সারাজীবন ইহুদি-বিদ্বেষে ভুগেছেন । যেটি পুরোপুরি পরিষ্কার নয় তা হল ইহুদি সম্পর্কে সেলিনের কুৎসিত মতামতগুলো তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাসে তেমন ছিল না । তাঁর ক্রোধ এবং বিদ্বেষ কোথা থেকে পয়দা হয়েছিল তা স্পষ্ট টের পাওয়া যায় না। যখন তিনি প্যারিসের কিছু নাৎসি দখলদারদের সাথে বসে খাবার খেতেন আর আড্ডা মারতেন, তখনও কিন্তু ইহুদিদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন আর অনেক বিশিষ্ট ইহুদি বুদ্ধিজীবী যুদ্ধের পরে সেলিনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন। অনুমান করা হয় যে সেলিনের রাজনৈতিক পুস্তিকাগুলোতে ব্যক্ত মতামত তাঁর বাবা-মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া–– বিশেষ করে তাঁর বাবার কাছ থেকে। তাঁর বাবা নিজের যৌবনের সাহিত্য-শিক্ষা ও লেখক হবার পরিকল্পনা ছেড়ে দিয়ে তার ব্যর্থতার জন্য ইহুদি এবং গুপ্ত-ভাতৃসঙ্ঘের সদস্যদের দায়ী করেছিলেন । সার্ত্রের মতো লেখকরা সেলিনের তীব্র ইহুদিবিদ্বেষের কারণে তাঁকে লেখক হিসেবে বিবেচনার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছিলেন।
.
তিনি তিনটি ইহুদি-বিরোধী প্রচারপত্র প্রকাশ করেন : শিরোনাম ছিল ‘ট্রাইফেলস ফর এ ম্যাসাকার’ (ব্যাগেটেলস পউর আন ম্যাসাকার), ‘স্কুল ফর কর্পসেস’ (এল’কোলে দেস ক্যাডাভ্রেস) এবং ‘এ ফাইন মেস’ (লেস বেউক্স ড্রপস)—বই তিনটির কারণে তিনি উগ্র দক্ষিণপন্হী হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছিলেন যারা পপুলার ফ্রন্ট, সংসদীয় গণতন্ত্র এবং আধুনিকতার অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। যদিও তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি, তাঁর অপ্রতিরোধ্য বর্ণবাদী ইহুদি-বিরোধী জাতিবাদ, জার্মানদের সঙ্গে সহযোগীতাবাদী কার্যকলাপ এবং ফরাসি জাতির প্রতি স্বঘোষিত বিতৃষ্ণার কারণে ভিচি শাসনামলের শেষের দিকে তাঁকে শত্রুপক্ষের লেখকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল । জানুয়ারি ২০১১ সালে ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রী ফ্রেদেরিক মিতেরঁ সংস্কৃতির জাতীয় উদযাপন উপলক্ষে বিখ্যাত ফরাসি লেখকদের তালিকা থেকে লুই ফার্দিনাঁ সেলিনের নাম প্রত্যাহার করে নেন । এই সিদ্ধান্তের কারণে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মেরুকরণ ঘটে। অনেকে মিতেরঁর হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে ছিলেন। আবার অনেকে সেলিনের পক্ষ সমর্থন করে বলেছিলেন যে তিনি এক বিরল সাহিত্যিক প্রতিভা এবং তাঁকে অবশ্যই লেখক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ।
.
ফ্রান্সে ইহুদি-বিরোধিতা বহু কালের । ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের মতে ভলতেয়ার অন্ধকার ছড়িয়ে গেছেন, আলো নয়। তিনি খ্যাতনামা দার্শনিক হলেও প্রকৃতপক্ষে ছিলেন একজন বর্ণবাদী এবং ইহুদি-বিরোধী যিনি হিটলারকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। প্যারিসে তাঁর মূর্তি অপসারণের জন্য বহুকাল ধরে দাবি করছিলেন জনসাধারণ। ভলতেয়ারের ‘লেট্রিস ফিলোসফিক্স’, ‘ডিকশনেয়ার ফিলোসফিক’, এবং কাঁদিদ’, এবং তাঁর আরও কয়েকটি কাজ, ইহুদি আর ইহুদি ধর্মে সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্যে ঠাশা। ভলতেয়ারের ইহুদি-বিরোধী মতামত ফ্রান্সের জনগণের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল ।
.
খোলাখুলিভাবে কয়েকটা ইহুদি-বিরোধী উপন্যাস শতাব্দীর শুরুতে প্রকাশিত হয়েছিল, যা দ্রেফুজ মামলার প্রভাবে উদ্ভূত অতি-জাতীয়তাবাদী অনুভূতির তরঙ্গকে প্রতিফলিত করেছে। যেমন, পল অ্যাডামের ‘দি এসেন্স অব দি সান( ১৮৯০), লিয়ঁ ক্লদেলের ‘ওয়ানডারাইঙ জিউয়েস. ( ১৮৯৭), লিয়ঁ দদেত-এর ‘দি কান্ট্রি অব পার্লিয়ামেন্টারিয়ানস’ ( ১৯০১) এবং ‘দি ফাইট’ ( ১৯০৭ )। এই সমস্ত উপন্যাসে দেখানো হয়েছে যে ইহুদি হল এক জঘন্য ষড়যন্ত্রকারী, জাতির নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে এবং নৈতিকতাকে কলুষিত করে। একই সময়ে মরিস দনে লিখেছিলেন ‘দি রিটার্ন ফ্রম জেরুজালেম’ ( ১৯০৪ ) নামে একটি ইহুদি-বিরোধী নাটক । সেলিনের মতনই ‘জিলেস’( ১৯৩৯)-এর লেখক পিয়ের দ্রিউ লা রশেল জার্মানদের অধীনে ‘ইহুদি-বিরোধী’ রাজনীতির সঙ্গে আপস করেছিলেন। ওয়ালটার বেনিয়ামিন একে বলেছেন ফ্যাসিবাদী "রাজনীতির নান্দনিকীকরণ" ।
.
খ্রিস্টধর্মীদের গির্জার শিক্ষায় ইহুদিদের প্রতি শত্রুতা চতুর্থ শতাব্দীতে সেন্ট অগাস্টিন থেকে ষোড়শ শতাব্দীতে মার্টিন লুথার পর্যন্ত লাগাতার প্রবাহিত হয়েছে। বাগ্মী এবং প্রচারক খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকরা ইহুদিদেরকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এবং প্রভুর হত্যাকারী হিসাবে শিক্ষা দিতেন। শয়তানের সঙ্গী এবং ইডেন উদ্যানের সাপের জাতি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। গির্জার লিটার্জি, বিশেষ করে ক্রুসিফিকেশনের গুড ফ্রাইডে স্মরণের জন্য শাস্ত্রীয় পাঠ, এই শত্রুতাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল।
.
প্যারিসে তাঁর অস্থির যৌবনের কারণে, লুইকে ১৪ বছর বয়সে বিদেশে পাঠান তাঁর বাবা । ইংল্যান্ড এবং জার্মানিতে থাকার দরুন সেখানকার ভাষাগুলো সেলিনের ভ্রমণ আর ফ্রান্সের দখলের সময় কাজে লেগেছিল। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁকে জার্মান দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য পড়তে সাহায্য করেছিল, বিশেষত শেক্সপিয়র এবং জোসেফ কনরাড, যাঁদের রচনাগুলো তাঁর লেখক-জীবনকে প্রভাবিত করেছিল।
.
পেশায় চিকিৎসক, সেলিন তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভার জন্য প্রশংসিত হলেও, অন্যভাবে পরিচিত তাঁর ইহুদি-ঘৃণা এবং মানববিদ্বেষের জন্য। ইহুদি-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হতে পারেননি সেলিন ; তাঁর সময়ের সবচেয়ে কট্টর ইহুদি-বিরোধী গোষ্ঠীগুলোতে তাঁকে ঘন ঘন দেখা যেত। ইহুদি-বিরোধী পত্রিকায় পঁয়ত্রিশটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর লাগামহীন ইহুদি বিরোধিতা জার্মান লেখক আর্নস্ট জাঙ্গার (১৮৯৫-১৯৯৮) কেও আতঙ্কিত করেছিল, যখন তাঁরা দখলকৃত প্যারিসে ছিলেন।সেলিন তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় ভ্রমণে কাটিয়েছেন; সর্বনাশের দূত হিসাবে, ব্যাপারটা তাঁর জন্য ছিল একধরনের রাজনৈতিক ছুটি, আধুনিক বিশ্ব থেকে অব্যাহতি পাবার উপায়। একটি পুস্তিকায় সেলিন লিখেছিলেন—
.
“মানুষের প্রকৃত বন্ধু কি? ফ্যাসিবাদ। শ্রমিকের জন্য কে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে? ইউএসএসআর নাকি হিটলার? অবশ্যই হিটলার। আপনার চোখে লাল রঙের গু ছাড়াই সবকিছু আপনাকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। ছোট দোকানদারের কে সবচেয়ে বেশি উপকার করেছে? থোরেস নয়, হিটলার করেছে ! আমাদের যুদ্ধে যেতে কে বাধা দিচ্ছে? হিটলার ! সমস্ত কমিউনিস্টরা (ইহুদি বা ইহুদিবাদী) ভাবে, ক্রুসেডে গলা টিপে মারার জন্য ,আমাদের মৃত্যুর দিকে পাঠাচ্ছে, । হিটলার মানুষকে বড় করতে চাইছেন, তিনি জীবনের পক্ষে, তিনি মানুষের জীবন এবং এমনকি আমাদের কথাও চিন্তা করেন। তিনি আর্য।”
.
১৯১২ সালে সেলিন অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগ দেন। কিন্তু ১৯১৪ সালের ২৭ অক্টোবর তাঁর হাত গুরুতরভাবে জখম হয়ে যায়, যার দরুন তাঁকে সৈন্যবাহিনীর জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।যুদ্ধের সময় তিনি লন্ডন ও আফ্রিকায় যাবার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফ্ল্যান্ডার্সের যুদ্ধে সামনের সারিতে থাকাকালীন তার বাহুতে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন সেলিন । ভয়ে যে ডাক্তাররা হাত বাঁচানোর চেষ্টা করার বদলে কেটে ফেলবে, সেলিন এনেস্থেশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যাতে তিনি ডাক্তারদের কাজ দেখতে পান । তাঁর শ্রবণশক্তির গুরুতর ক্ষতি হয়েছিল। তবে বীরত্বপূর্ণ আচরণের জন্য একটি পদক দিয়ে সামরিক বাধ্যবাধকতা থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার ডান হাত সারা জীবন আংশিকভাবে অবশ হয়ে গিয়েছিল আর একটা কানে কম শুনতে পেতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অশ্বারোহী অফিসার হিসেবে মাথার ক্ষতের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থেকে ১ জুলাই, ১৯৬১-এ সেলিন মারা যান।
.
যুদ্ধের পর সেলিন অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে ডাক্তারি শেখেন । চিকিৎসাবিদ্যায় তাঁর থিসিস ছিল ডক্টর ইগনাজ ফিলিপ সেমেলওয়েস (১৮১৮-১৮৬৫) এর জীবন সম্পর্কে গবেষণা। লন্ডনে থাকার সময়ে ১৯১৫ সালে সেলিন সুজান নেব্যু নামে এক যুবতীকে বিয়ে করেন আর ইংল্যাণ্ড ছাড়ার সময়ে স্ত্রীকেও ছেড়ে দেন। ১৯১৯ সালে বিয়ে করেন এডিথ ফোলেকে ; তাঁকে এবং তাঁদের মেয়ে কোলেতকে ছেড়ে চলে যান ১৯২৫ সালে লিগ অফ নেশানসের চাকরিতে যোগ দিতে। তৃতীয়বার বিয়ে করেন ১৯৩৬ সালে নর্তকী লুসেত আলমানজোরেকে যাঁর বয়স ছিল ২৩ এবং লেখকের ৪১, যদিও ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’ অন্য আরেক নৃত্যশিল্পী এলিজাবেথ ক্রেগকে উৎসর্গ করেছিলেন । লুসেত সেলিনের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে ঈর্ষান্বিত স্বামীর সাথে ছিলেন। তাঁর স্মৃতিকথা, ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। লুসেত সেলিনের নাম তার আগে শোনেননি, একটা নাচের আসরে তাঁদের পরিচয় হয়েছিল, যেখানে লুসেত মহড়া দিচ্ছিলেন।সেলিন ১৮ বছরের বড় ছিলেন এবং এর আগে দুবার বিয়ে করেছিলেন কিন্তু বন্ধু হয়ে উঠতে অসুবিধা হয়নি । "আমি আমার বাকি দিনগুলো তোমার সাথে কাটাতে চাই," সেলিন তাঁকে প্রথম চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমি মারা গেলে আমার আত্মাকে সংরক্ষণ করার জন্য আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি।”
.
দ্বিতীয় স্ত্রী এডিথ ফোলেকে এই চিঠিটি লিখে ছেড়ে চলে যান সেলিন—-
“তোমাকে কিছু খুঁজে পেতে হবে যাতে তুমি প্যারিসে স্বাধীনভাবে থাকতে পারো । আমার জন্য, আমি সম্ভবত কারো সাথে থাকতে পারি না –- আমি তোমাকে কাঁদিয়ে এবং দুঃখী করে আমার পিছনে টেনে নিয়ে যেতে চাই না, তুমি আমাকে বিরক্ত করেছ - আমার সাথে ঝুলে থেকো না। আমি তোমার সাথে বেঁচে থাকার চেয়ে নিজেকে বরং খুন করে ফেলব - এটি জেনে নাও আর যোগাযোগ, কোমলতা দিয়ে আমাকে বিরক্ত কোরো না - তার বদলে জীবনকে তোমার পছন্দ মতো সাজিয়ে নাও। আমি একা থাকতে চাই, একা, একা, আধিপত্য বা কারো তত্ত্বাবধানে নয়, ভালোবাসতে চাই না: মুক্ত। আমি বিয়েকে ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, আমি এতে থুতু ফেলি। আমার জন্য এটা একটা কারাগারের মতো যেখানে আমি মারা যাচ্ছি।”
.
১৯২৪ সালে মেডিকেল ডিগ্রি পেয়ে সেলিন ১৯২৭ পর্যন্ত লিগ অফ নেশনসের জন্য চিকিৎসা মিশনে ছিলেন। লিগ অফ নেশনস -এর জন্য কাজ করার সময় ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা জুড়ে ভ্রমণের সুযোগ পান।১৯২৫ সালে, বাবা-মায়ের আস্তানা চিরকালের মতো ছেড়ে চলে যান। ১৯৩১ সালে চাকরি নেন এক মিউনিসিপ্যাল ক্লিনিকে । সেখানে তিনি অত্যন্ত গরিব আর দুস্হদের চিকিৎসা করার সময়ে তাদের বুলির সঙ্গে পরিচিত হন। সেই সময় থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত , আর্থিক অসুবিধা সত্ত্বেও অভাবীদের চিকিৎসা করেছেন আর উপন্যাসের মাল-মশলা সংগ্রহ করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে অন্যের কষ্ট থেকে অর্থ উপার্জন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
.
তিন
.
১৯২৯ সালে তিনি উপন্যাস লেখা শুরু করেন। সেই বই,’জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’( ১৯৩৪ ) প্রকাশের সাথে-সাথে সেলিনকে একজন শীর্ষ এবং উদ্ভাবনী ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল । তিনি আক্রোশের সঙ্গে যুদ্ধ-বিরোধী এবং ঔপনিবেশিকতা বিরোধী অবস্থান নিয়ে নৈরাজ্যবাদী হিসাবে একই সঙ্গে নিন্দিত ও সমাদ্রিত হলেন। উপন্যাসের নায়ক-কথক, বারদামু, একজন মানুষের অত্যাচার-জর্জরিত জীবনের মানে এবং অস্তিত্বের মর্মার্থের জন্য আশাহীন অনুসন্ধানের গল্প, একটি তীব্র এবং বিচ্ছিন্ন শৈলীতে লেখা, যা লেখককে বিশ শতকের ফরাসি সাহিত্যের প্রধান উদ্ভাবক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। বারদামু চরিত্রটি সেলিনের নিজের অভিজ্ঞতার কাছে ঋণী, তার স্রষ্টার মতোই বিখ্যাত হয়ে ওঠে। উপন্যাসটা প্রকাশিত হবার পর-পর এক সাহিত্য কেলেঙ্কারির মধ্যে পড়ে। সমর্থন সত্বেও গঁকুর পুরস্কার পেতে ব্যর্থ হয়, যদিও বামপন্হীদের, বিশেষত লুই আরাগঁ (১৮৯৭-১৯৮২) এর মতো লেখকদের দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল, যাঁরা লুই ফার্দিনাঁ সেলিনের ইহুদি-বিদ্বেষ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না।
.
তাঁর উপন্যাসের নিরলস হতাশা, নৈতিকতা, ক্রোধ এবং কামোত্তেজকতা কিছু সমালোচককে বিরক্ত করেছে, যাঁরা তাঁর অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপত্তি করেন অথচ তাঁরা সেলিনের গদ্যের লিরিসিজমের প্রশংসা করেন। অন্যান্য সমালোচকরা সেলিনের বেদনাদায়ক আস্ফালনে একটি বিদ্রোহী মানবতাবাদ খুঁজে পান এবং তাঁর বিদ্রোহকে বিশ্বের অসহনীয় মন্দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। যদিও এটা সত্য যে অন্যান্য লেখকরা উন্মাদনা এবং ক্রোধের মতো বিষয়গুলিকে মোকাবেলা করেছিলেন, কিন্তু সেই উপস্থাপনাগুলির বেশিরভাগই শিক্ষিতদের ভাষায় লেখা হয়েছিল এবং ঐতিহ্যগত উপন্যাস ফর্মের সীমাবদ্ধতায় আটক ছিল। সেলিনের অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি-উপন্যাসের ভাষা ও রূপকে এর থিমের সাথে এবং চরিত্রের সাথে মেলানোর জন্য-একটি সাহিত্যিক রূপ হিসাবে উপন্যাসের নতুন ব্যাখ্যার দিকে পরিচালিত করেছে। পরিমার্জন এবং রীতির পুরোনো মানদণ্ডে চরিত্রগুলোর কথাবার্তা প্রলাপ সুলভ মনে করাকে নাকচ করে দিতে পেরেছিলেন সেলিন। আঁদ্রে জিদ বলেছিলেন: "সেলিন যা লেখেন তা বাস্তবতা নয়, বরং হ্যালুসিনেশন, যা বাস্তবতা থেকে পয়দা হয়।" ১৯৭৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমস-এ ঔপন্যাসিক ম্যাভিস গ্যালান্ট লিখেছিলেন "সেলিনের অন্ধকার নৈরাজ্যবাদ", "তাঁর রাস্তাছাপ ভাষার ব্যবহার, রহস্য এবং মৃত্যুর হাতছানি উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানাটান ঘটনা বাম এবং ডান উভয়ের কাছেই ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়; দুপক্ষই এতে পতন, নোংরা গণতন্ত্রের অবসান, অসুস্থ ইউরোপের মৃত্যু সম্পর্কে একটি ভবিষ্যদ্বাণী পায়।”
.
সেলিনের লেখক-বিরোধীতায় এমন কিছু ছিল যা এক ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের শেষে এবং পরবর্তীতে অনেক পাঠককে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি কখনো তাঁর পাঠকদের ওপর কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করেননি, বিশেষ করে শিল্প বা সাহিত্য করছেন বলে দাবি করেননি ; তিনি কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি বা একাডেমিক শব্দ ব্যবহার করেননি; এবং তিনি তাঁর সময়কার ঔপন্যাসিকদের কয়েকজনের লেখা পড়েছেন বলে দাবি করেননি। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সাহিত্য সমাজের সমস্যাগুলি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভাল হতে পারে, আপনি যদি সত্যিকারের ভাল করতে চান তবে আপনাকে একবারে একজন রোগীর ব্যক্তিগত অসুস্থতাগুলিকে উপশম করার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। "আমি দারিদ্র্যের মধ্যে শুরু করেছিলাম, এবং এভাবেই আমি শেষ করছি।” সেলিনের তিক্ত, বিস্তৃত, নারকীয় কল্পনার কালো হাসির ঝলক না থাকলে, সম্ভবত হেনরি মিলার, বিট আন্দোলন, জাঁ জেনে, কার্ট ভনেগাট, নাথানিয়েল ওয়েস্ট, হুবার্ট সেলবি, টমাস পিনচন, উইলিয়াম গ্যাডিস-এর মতন লেখক পাওয়া যেতো না।
.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যেহেতু ফ্রান্স মূলত জার্মান বাহিনীর দখলে ছিল, সেলিন বেশ কিছু পুস্তিকা লিখেছিলেন যেগুলিকে ইহুদি বিরোধী বা ইহুদিদের প্রতি নেতিবাচক হিসাবে দেখা হয়েছিল।১৯৪৪ সালের জুন মাসে মিত্রবাহিনী নরম্যান্ডিতে নামলে, সেলিন প্যারিস থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন কারণ তিনি আঁচ করেছিলেন যে তাঁকে শীঘ্রই গ্রেপ্তার করা হবে, একটি ন্যায্য বিচার প্রত্যাখ্যান করা হবে এবং সম্ভবত তাঁর ইহুদি বিরোধীতা এবং সাম্যবাদের প্রতি শত্রুতার কারণে শত্রুর সাথে সহযোগিতা করার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। সেলিন আর তাঁর তৃতীয় স্ত্রী, ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে প্যারিস ছাড়ার পরে, তাঁর ফ্ল্যাটে ভাংচুর করা হয়েছিল, নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল তাঁর লাইব্রেরি আর কাগজপত্র । ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে, সেলিন জার্মান শহর সিগমারিংজেনে বসবাস আরম্ভ করেন।
.
যদিও প্রথমদিকে বামপন্থী রাজনীতিকদের একজন প্রিয় লেখক ছিলেন, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের পর সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা দেখে হতাশ হয়ে পড়েন আর ‘মেয়া কুলপা’ ( ১৯৩৭ ) রচনায় তা স্পষ্ট করেন । পরে তিনি ধর্মান্ধভাবে ইহুদি-বিরোধী মনোভাব গড়ে তোলেন, যা লিখে তিনটি প্যামফ্লেট প্রকাশ করেন: ‘গণহত্যার মামুলিপনা’ ( ১৯৩৭ ), ‘মৃতদেহের স্কুল’ ( ১৯৩৮ ) এবং ‘সুন্দর চাদর’ ( ১৯৪১ )। এই পুস্তিকাগুলোতে সেলিন ফরাসিদেরও আক্রমণ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সেলিন অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবাতে তালিকাভুক্ত হন, কিন্তু ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের পতনের পর তিনি সহযোগিতা আর প্রতিরোধ দুটো শিবিরকেই প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরিবর্তে বেজোনসে একটি ডিসপেনসারিতে কাজ করতে ফিরে যান। তাঁকে জার্মান খোচর হিসেবে অভিযুক্ত করা হবে এই ভয়ে, তিনি ফ্রান্সের মিত্রবাহিনীর মুক্তির সময় জার্মানির মাধ্যমে ডেনমার্কে পালিয়ে যান, যেটি তখন মিত্রবাহিনীর বোমা হামলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ডেনমার্কে তাঁকে এক বছরেরও বেশি সময় জেলে পোরা হয়েছিল। সেসময়ে ফরাসি কর্মকর্তারা তাঁকে জার্মান খোচরগিরির জন্য অভিযুক্ত করেছিল এবং তাঁর প্রত্যর্পণের দাবি করেছিল।
.
১৯৪৫ সালের এপ্রিলে, ফরাসি আদালত নাৎসি সহযোগী হিসাবে সেলিনের গ্রেপ্তারের জন্য পরোয়ানা জারি করে। যখন কোপেনহেগেনে ফরাসি কর্মকর্তারা সেলিনকে অবিলম্বে নির্বাসিত করার দাবি জানায়, তখন ডেনিসরা তাকে চৌদ্দ মাস এবং তার স্ত্রীকে দুই মাসের জন্য কারারুদ্ধ করে সাড়া দেয়। খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য, সেলিনকে ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। চার মাস পরে সুস্থ হয়ে উঠলে, তাঁকে এই শর্তে মুক্ত করা হয়েছিল যে তিনি ডেনমার্কে থাকবেন, যেখানে তিনি ১৯৫১ সালের এপ্রিলে সাধারণ ক্ষমা না হওয়া পর্যন্ত ছিলেন।
.
১৯৪৮ সালে তিনি প্যারিসের শহরতলি মিউদঁতে ডিসপেনসারি খোলেন, আর অবসর সময়ে লেখালেখি আরম্ভ করেন। সেলিন ডাক্তার হিসাবে কাজ করার সময় উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন। তাঁর প্রথম কাজ, জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট , লিখতে সময় লেগেছিল পাঁচ বছর। ১৯৩২ সালে এটি শেষ হলে, এক হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি দুটি ফরাসি প্রকাশনা সংস্থা, গ্যালিমার এবং ডেনোয়েলের কাছে জমা দেন । গ্যালিমার বইটিকে খুব বিতর্কিত বলে মনে করে, কিন্তু রবার্ট ডেনোয়েল, একজন নতুন প্রকাশক, যিনি আরও বেশ কয়েকটি বিতর্কিত পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করেছিলেন, সেলিনের উপন্যাসটা ছাপেন। তাঁর সাহিত্যিক আর চিকিৎসা জীবন আলাদা করার জন্য, দেশতুশের বদলে সেলিন ছদ্মনামে উপন্যাস প্রকাশ করেন।‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ নাইট’ প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁকে খ্যাতি এনে দেয় ; আখ্যানবস্তু হলো , একজন মানুষের নির্যাতিত এবং অর্থের জন্য আশাহীন অনুসন্ধানের প্রয়াস, একটি ভাঙাভাঙা ফরাসি গদ্যে সাধারণ মানুষের বুলিতে লেখা যা তাঁকে চিহ্নিত করেছিল বিংশ শতাব্দীর ফরাসি সাহিত্যের প্রধান উদ্ভাবক হিসেবে। তারপর লেখেন ‘ডেথ অন দ্য ইনস্টলমেন্ট প্ল্যান’, ( ১৯৩৬ ), যে উপন্যাসে মানুষের মূল্যবোধহীনতা, সৌন্দর্য ও শালীনতা-বঞ্চিত একটি পৃথিবীর একইরকম অন্ধকার চিত্রিত হয়েছে।
.
সেলিনের অসূয়াপূর্ণ, রহস্যঠাশা ও কৌতুকভরা ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’ এর প্রকাশনা ফরাসি সাহিত্য জগতে আঘাত তরঙ্গ তুলেছিল যা তখনও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সামাজিক এবং শৈল্পিক অবনমন থেকে ভুগছিল। এর সাহসী প্যারিসীয় বুলি, অপভাষা, অশ্লীল, মজার, রাস্তাছাপ বাক্য একসাথে যুদ্ধ, ঔপনিবেশিকতা, শিল্পবাদ, এবং হেনরি মিলার যাকে বলবেন, বিশ শতকের জীবনের "এয়ারকন্ডিশন্ড দুঃস্বপ্ন", তাকে উপস্হাপন করেছেন সেলিন। উপন্যাসটি তখন থেকে একটি উজ্জ্বল এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ, যদিও তিক্ত এবং প্রায়শই অসন্তুষ্ট, তবু তা আধুনিক অবস্থার ভাষ্য। গদ্যটি পাঠকের মস্তিষ্কে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেডের মতো, ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা ফুটো করে বাতাসে উড়িয়ে দেয়, বাক্য এবং শব্দ গজিয়ে ওঠে ছত্রাকের মতন। উপন্যাসটি ব্যাকরণের দাসত্ব এবং বাক্য গঠনের ভাঙ্গা হাড়ের নিয়ম ছেড়ে রৈখিক আখ্যানকে বিকৃত করতে করতে এগোয়।
.
যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে জানায় যে ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’- এর রাশিয়ান অনুবাদ থেকে রয়্যালটি পাঠাবে না তখন সেলিন ১৯৩৬ সালে দেশটিতে যান। সেই সফরের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি । ফলস্বরূপ, সেলিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে চারটি রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন । দেশটিকে বস্তুবাদের উপর ভিত্তি করে একটি দুষ্ট একনায়কত্ব বলে অভিহিত করেন। সেলিনের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিকরা নোংরা অবস্থায় বাস করত আর তারা একটি দুর্নীতিগ্রস্ত নতুন শাসক শ্রেণী– কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা শোষিত হচ্ছিল ।
.
চার
.
সাহিত্যে সেলিনের অবদান প্রাথমিকভাবে তাঁর রোগিদের ফরাসি বুলির ব্যবহার —যার মধ্যে বঞ্চিত ও রুগ্ন মানুষের সমস্ত ক্ষোভ ও প্রতিশোধ স্পৃহা ও অপ্রচলিত চক্রান্ত সম্পর্কিত উদ্বেগ বুনেছেন লেখক। তাঁর উপন্যাসগুলো দীর্ঘ এবং অশোধিত প্রথম-ব্যক্তি বর্ণনা এবং বিচ্ছিন্ন প্লট নিয়ে গঠিত, যা প্রায়ই পাঠককে বিভ্রান্ত করে। সেলিনের উপন্যাসের বর্ণনাকারীরা যেন ভ্রান্ত, বেপরোয়া মৌখিক আক্রমণ করে, হিংস্র হাস্যরসে আনন্দ পায়, এবং আফ্রিকার জঙ্গল থেকে ডেট্রয়েটের কারখানায় পৌঁছে যায় এক লপ্তে । তার অসংযত ভাষা হল ফরাসি স্ল্যাং, গালমন্দ, রাস্তার ব্যাকরণহীন প্রলাপের এক অনন্য সংমিশ্রণ। তার প্লেটগুলো অম্লীয় ব্যঙ্গ দ্বারা সজ্জিত। সেলিনের কাজকে প্রায়শই আর্তুর র্যাঁবো এবং শার্ল বদল্যারসহ আগের লেখকদের সাথে তুলনা করা হয়েছে । কেউ কেউ যুক্তি দেন যে সেলিনের উপন্যাসগুলো তাদের ক্রোধ এবং হীনমন্যতায় অতুলনীয়। সেলিন তাঁর উপন্যাসে ফরাসি গালমন্দ ব্যবহার করেছেন উজ্জ্বল প্রভাবের জন্য, যেমন উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর সময়ের ইংরেজি অপভাষা ব্যবহার করেছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত "সঠিক" ভাষা এবং "অপভাষার" মধ্যে একটি পার্থক্য বজায় ছিল, লেখকরা পার্থক্যগুলো মানতেন।সেলিনের পর কোনো সৃষ্টিশীল গদ্যকার আর সেসব মানেন না ।
.
প্যারিসের একটি সামরিক ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ক্ষমা করার পর ১৯৫১ সালে তিনি ফ্রান্সে ফিরে যান। ফিরে গিয়ে তিনি আবার ডাক্তারি শুরু করেন আর পাসাপাশি লেখালেখি করতে থাকেন। তাঁর শেষ কাজগুলো যথাক্রমে, ‘ক্যাসল থেকে ক্যাসেল’ (১৯৫৭ ), ‘নর্ড’ ( ১৯৬০), এবং ‘রিগাদুন’ ( ১৯৬৯ ) যা আসলে একটি ট্রিলজি, জার্মানির ভেতর থেকে দেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে চিত্রিত করেছেন। সমালোচকদের মতে শক্তি এবং শৈলীতে তাঁর দুটি বিখ্যাত প্রাথমিক উপন্যাসের সমান এই ট্রিলজি । অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে ‘গুইগনোল’স ব্যাণ্ড ( ১৯৪৪ ), কাসে পাইপ ( ১৯৪৯ ) , ‘শুটিঙ গ্যালারি’ এবং ‘কনভারসেশানস উইথ প্রফেসর ওয়াই’ ( ১৯৫৫)। সম্প্রতি সেলিনের ‘গুয়েরে’ বা ‘যুদ্ধ’ নামের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হয়েছে।
.
১৯৩০-এর দশকে সেলিনের খ্যাতি বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু যুদ্ধের বছরগুলোতে এবং পরে তাঁর ক্রমবর্ধমান মানববিদ্বেষের কারণে কিছুটা হ্রাস পায়। আসলে তাঁর কাহিনিগুলোতে নিরলস হতাশা, নীতিহীনতা, ক্রোধ এবং কামোত্তেজক প্রকাশভঙ্গী কিছু সমালোচক গ্রহণ করতে পারেননি , যাঁরা একদিকে সেলিনের অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপত্তি করেন অথচ তাঁর গদ্যের লিরিসিজমের প্রশংসা করেন। আবার কিছু সমালোচক সেলিনের বেদনাদায়ক পাঠবস্তুতে একটি বিদ্রোহী মানবতাবাদ খুঁজে পান এবং তাঁর বিদ্রোহকে বিশ্বের অসহনীয় মন্দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন।তিনি এত শক্তিশালী বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন যে তার কাজটি অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বিশ বছর পরে যখন সেলিনের নাম মুছে ফেলা হয়েছিল তখনই ফরাসিরা তার জীবন এবং কাজের প্রকাশের অনুমতি পেয়েছিল। যখন তার লেখা জনসাধারণের কাছে উপলব্ধ হয়, তখন পাঠকরা জানতে পেরেছিলেন যে সেলিন একজন দক্ষ গদ্য-শিল্পী ছিলেন যাঁর ভাষা এবং উপন্যাসের কাঠামো নিয়ে পরীক্ষাগুলো সারা বিশ্বের লেখকদের প্রভাবিত করেছে।
.
লুই ফার্দিনঁ সিলিনের ঘনান্ধকারে আচ্ছন্ন দৃষ্টিপ্রতিভার দ্বারা অনুপ্রাণিত ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার লেখকদের মধ্যে জাঁ জেনে,স্যামুয়েল বেকেট, অ্যালাইন রবে-গ্রিয়ে, জাঁ পল সাত্রে, হেনরি মিলার, কার্ট ভনেগাট, জ্যাক কেরুয়াক, উইলিয়াম বারোজ, ফিলিপ রথ উল্লেখ্য। মানব অস্তিত্বের অন্ধকার মোচড়গুলো সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি সার্ত্রের উপন্যাস নজিয়া, যা অস্তিত্ববাদের পথনির্দেশক কাজ, এবং লা জালুসি, অ্যালাইন রবে-গ্রিয়ের আবেশী স্বামীর চিত্রায়নকে অনুপ্রাণিত করেছিল। "সেলিন আমার প্রুস্ত!" বলেছেন ফিলিপ রথ। "প্রত্যেক লেখকই তাঁর কাছে ঋণী," বলেছেন কার্ট ভনেগাট।সিলিন একটি উদ্ভাবনী এবং স্বতন্ত্র সাহিত্য শৈলী গড়ে তুলেছিলেন। মরিস নাদেউ লিখেছেন: "ইংরেজি ভাষার জন্য জেমস জয়েস যা করেছিলেন, পরাবাস্তববাদীরা ফরাসি ভাষার জন্য যা করার চেষ্টা করেছিলেন, সিলিন অনায়াসে এবং বিশাল পরিসরে তা অর্জন করেছিলেন।আধুনিক ফরাসি সাহিত্যের এক অন্যতম প্রবর্তক হিসেবে তাঁকে গণ্য করা হয় । নিজের উপন্যাসে বুর্জোয়াদের "অতিপ্রাকৃত" ভাষা বর্জন করে, তিনি সাধারণ মানুষর দ্বারা পথ-চলতি ফরাসি বুলি ব্যবহার করেছেন। সেলিনের কাজকে জেমস জয়েসের আধুনিকতাবাদী, চেতনাপ্রবাহ শৈলীর সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়; এর অশ্লীলতার জন্য মিলার; হেমিংওয়ে তার স্থুলতার জন্য, যা ফরাসি ভাষায় আরও বেশি ঝাঁকুনি দেয় যেখানে বাক্যগুলো সাধারণত ইংরেজির চেয়ে দীর্ঘ হয়। সেলিন এবং হেমিংওয়ের মধ্যে মিল এখানেই শেষ নয়। দুজনেই সামনের দিকে আহত হয়েছিলেন, ইতালিতে হেমিংওয়ে তাঁর ১৯ তম জন্মদিনের কয়েক সপ্তাহ আগে, আর ২০ বছর বয়সে ফ্রান্সে সেলিন। উভয়ই বিশ্ব ভ্রমণকারী ছিলেন এবং প্যারিসের রাস্তার জনগণের সঙ্গে মিশে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। উভয়েই আধুনিকতাবাদী গদ্য স্টাইলিস্ট ছিলেন, তাঁরা যে ভাষায় লিখেছেন তার উপর দীর্ঘ ছায়া ফেলেছেন। এমনকি তাঁরা একে অপরের কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যান।
.
যদিও এটা সত্য যে অন্যান্য লেখকরা উন্মাদনা এবং ক্রোধের মতো ব্যাপারগুলোকে নিজেদের লেখালিখিতে মোকাবেলা করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের উপস্থাপনাগুলোর বেশিরভাগই শিক্ষিতদের ভাষায় বোনা হয়েছিল এবং চিরাচরিত উপন্যাসের আঙ্গিকে সীমাবদ্ধ ছিল। সেলিনের অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি-উপন্যাসের ভাষা ও রূপকে এর থিমের সাথে এবং চরিত্রের সাথে মেলানোর জন্য-একটি সাহিত্যিক রূপ হিসাবে উপন্যাসের নতুন আঙ্গিকের দরোজা খুলে দিয়েছে । পাঠকরা পরিমার্জন এবং রীতির সুরক্ষার বাইরে চরিত্রগুলোর অদ্ভুত আচরণ ও কথাবার্তার সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হয়েছে।
.
পাঁচ
.
লুই-ফার্দিনাঁ সেলিনের কয়েকটা নতুন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া গেছে, একটার নাম, "গুয়েরে" বা "যুদ্ধ,"। সম্প্রতি ফ্রান্সে, গ্যালিমার তা প্রকাশ করেছে। উপন্যাসটিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে, সেলিনের মস্তিষ্কের সবকিছু আছে আর এর ভাল এবং মন্দ নিয়ে অনেক পুনরুজ্জীবিত যুক্তি আবির্ভূত হয়েছে, তাঁর সাহিত্যিক মূল্যকে তাঁর রাজনৈতিক প্যাম্ফলেটিয়ারিংয়ের জঘন্য ইহুদি-বিরোধিতা থেকে আলাদা করা যায় কিনা এবং কীভাবে উপন্যাসটির মূল্যায়ন করা উচিত তা আবার নতুন করে দেখা দিয়েছ। বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাগুলিতে, কথক মৃতদেহের পাশে শুয়ে আছে, যখন একজন সৈনিক—যার বর্ণনার চেতনা প্রমাণ করবে— যে তার কান মাটির সাথে রক্তে আটকে গেছে এবং বিস্ফোরণের শব্দে তার মাথা কেঁপে উঠছে, অবাক হচ্ছে যে সে আহত হয়েছে কিনা। এমনকি তার কর্তিত শরীরের সাথে বাহু তখনও জুড়ে আছে কিনা ; কাছাকাছি, দুটি ইঁদুর খাবারের সন্ধানে আরেকটি মৃতদেহের পিঠের ঝোলায় হুড়োহুড়ি করছে। সৈনিকটা, নিজের মগজে, স্থায়ীভাবে, কামানের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। বন্ধুত্ব সৈন্যরা মরিয়া অনুসন্ধানে মৃত্যুর মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে আরও তীব্র উপলব্ধি সম্ভবত সেলিনের এই বইয়ের আগে লেখা হয়নি। যুদ্ধকালীন ট্রেঞ্চের অন্যান্য বিখ্যাত বর্ণনাকে অবাস্তব মনে হতে পারে। যেমন হেমিংওয়ের "এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস"-এ স্ব-সচেতনভাবে কাব্যিক। এরিখ মারিয়া রেমার্কের "অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট," এক ধরণের পরিশীলিত বিতর্ক।
.
নতুন পাণ্ডুলিপি — "লন্ড্রেস" বা "লন্ডন" । সেটা "গুয়ের" এর সিক্যুয়েল সহ আরও দুটি বইয়ের প্রকাশও আসন্ন। এগুলো সেলিনের বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মতো একই সময়ে লেখা৷ পাণ্ডুলিপিগুলো ১৯৪৪ সালে হারিয়ে যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে, যখন সেলিন জানতে পেরেছিলেন যে তাঁকে ফ্রান্সে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। সেসময়ে তিনি প্রথমে জার্মানি, তারপর ডেনমার্কে পালিয়ে যান । পাণ্ডুলিপিগুলো কারোর কাছে থেকে যায় । ২০২০ সালে, বামপন্থী দৈনিক ‘লিবারেশন’-এর প্রাক্তন থিয়েটার সমালোচক জাঁ-পিয়ের থিবাউদাত পাণ্ডুলিপিগুলো খুঁজে পান। (সেলিনের স্ত্রী, যিনি কপিরাইটের মালিক, আগের বছর একশ সাত বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন।)। "গুয়েরে" পুরোটা যুদ্ধের বিষয়ে নয় ; বরং যুদ্ধের আগের পরিস্হিতি সম্পর্কে। বর্ণনাকারীকে কেবল ফার্দিনাঁ হিসাবে দেখানো হয়েছে, সে তার আঘাত থেকে হাসপাতালে সেরে উঠছে — সহানুভূতিশীল এবং কামুকভাবে, প্রথমে একজন নার্সের আকর্ষণে , তার চিকিৎসা হয়। কষ্ট এবং মৃত সৈন্যদের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে। তারপর এক পতিতার সুশ্রষা তার দেহের আকাঙ্খাকে সুস্হ করে তোলে ।
.
১৯৬১ সালে তাঁর মৃত্যুর সময়, সেলিন সমসাময়িক ফরাসি সাহিত্যে একটি একক স্থান তৈরি করে গেছেন । অন্যান্য লেখকদের উপর তাঁর প্রভাবের জন্য তিনিব্যাপকভাবে পরিচিত কারণ সেলিন উপন্যাসের রূপ কী হতে পারে তার নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে গেছেন। ‘সেলিন অ্যান্ড হিজ ভিশন’ গ্রন্থে , এরিকা ওস্ট্রোভস্কি উল্লেখ করেছেন যে সেলিনের কাজ "একটি নতুন স্বর তৈরি করেছে, একটি সাহিত্যিক পরিবেশ যা আধুনিক সাহিত্যভাষার একটি সম্পূর্ণ এলাকাকে বিস্তৃত করে এবং জাতীয় সীমানা বা ব্যক্তিগত অভিযোজন এবং পটভূমির সীমা অতিক্রম করে চলে যায়।" নিরলস মনস্তাত্ত্বিক বাস্তববাদের জন্য কার্ট ভনেগাট থেকে ফিলিপ রথ পর্যন্ত লেখকরা সেলিনকে শ্রদ্ধা করেন। সেলিন লিখতে শুরু করলেন ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’, তার প্রথম উপন্যাস, ১৯২৯ সালে, যখন তিনি প্যারিসের শহরতলির শ্রমিক শ্রেণীর একটি পাবলিক ক্লিনিকে একজন ডাক্তার হিসাবে কাজ করছিলেন।
.
উপন্যাসগুলোর উত্তমপুরুষ ফার্দিনাঁ বারদামু হলেন একজন তরুণ প্যারিসীয় মেডিকেল ছাত্র যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটায় স্বেচ্ছায় ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। শত্রুর সাথে তাঁর প্রথম মোকাবেলার সময় তিনি টের পান যে যুদ্ধের কোন মানে হয় না এবং তাঁকে এই নরক থেকে বেরোতে হবে। নিশাচর অনুসন্ধান মিশনে একা, তিনি লিয়ঁ রবিনসন নামে একজন ফরাসি গার্ডের সাথে দেখা করেন কেননা সেও জার্মানদের দ্বারা বন্দী হতে চায় যাতে যুদ্ধ শিবিরের একজন বন্দীর আপেক্ষিক নিরাপত্তায় যুদ্ধ এড়িয়ে বসে থাকতে পারে। বারদামু আর রবিনসন একটা ফরাসি শহরে ঢোকে কিন্তু সেখানে আত্মসমর্পণ করার মতো কোনো জার্মান অধিকারীর খোঁজ পায় না৷ হতাশ হয়ে তারা তাদের আলাদা পথে চলে যায়।
.
বারদামু যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয় আর সামরিক পদক পায়। প্যারিসে সুস্থতার ছুটিতে, বারদামু লোলা নামে একজন আমেরিকান স্বেচ্ছাসেবক নার্সের সাথে দেখা করে যার সাথে তার সম্পর্ক ছিল। তারা একটা চিত্তবিনোদন পার্কে বেড়াতে যায়্ । সেখানে বরদামু শুটিং গ্যালারিতে স্নায়ুবৈকল্য আক্রান্ত হয়। সে লোলাকে বলে যে সে যুদ্ধ চায় না কারণ সে কোন কিছুর জন্য মরতে চায় না। লোলা তাকে বলে সে কাপুরুষ আর তাকে ছেড়ে চলে যায়।
.
বারদামু মুসিনের সাথে সম্পর্ক শুরু করে, যিনি একজন বেহালাবাদক। যাইহোক, তিনি শীঘ্রই বারদামুকে ছেড়ে চলে যান উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী আর্জেন্টিনীয়দের কাছে, যারা যুদ্ধ থেকে টাকাকড়ি কামিয়েছে। তাকে একটা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে বৈদ্যুতিক থেরাপি হয় আর ডাক্তাররা দেশপ্রেমিক মনোরোগবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ। অবশেষে তাকে চাকরির জন্য মনস্তাত্ত্বিকভাবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় এবং সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
.
বারদামু ফরাসি ঔপনিবেশিক আফ্রিকায় যায় যেখানে তাকে জঙ্গলের ভেতরে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রের দায়িত্বে রাখা হয়। এখানে ফরাসি প্রশাসনে তার সহকর্মী আলসাইডের সাথে বন্ধুত্ব হয়। বারদামু দেখতে পায় যে বাণিজ্যিক কেন্দ্রটা কেবল একটি জরাজীর্ণ কুঁড়েঘর, এবং বারদামু যার জায়গায় এসেছে তিনি হলেন রবিনসন। রবিনসন তাঁকে বলেন যে কোম্পানিটা তার কর্মচারী এবং স্থানীয়দের সাথে জোচ্চুরি। রবিনসন রাতে লুকিয়ে চলে যায়। কয়েক সপ্তাহ পর, বারদামু জ্বরে আক্রান্ত হয় আর জ্বরের ঘোরে বাণিজ্য কেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। কোম্পানির সাথে প্রতারণা করার শাস্তির ভয়ে, বারদামু উপকূলে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বারদামুকে জ্বরের ঘোরে প্রলাপগ্রস্ত দেখে,আশেপাশের গ্রামের লোকেরা তাকে একটা স্প্যানিশ উপনিবেশে নিয়ে যায় যেখানে একজন যাজক তাকে গ্যালি স্লেভ হিসেবে জাহাজের মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। জাহাজটা নিউইয়র্ক রওনা হয় যেখানে বারদামুকে তার জ্বর না কমা পর্যন্ত সবায়ের থেকে আলাদা করে রাখা হয়। বারদামু কোয়ারেন্টাইন কর্তৃপক্ষকে একটা চাকরি পাইয়ে দেবার কথা বলে। কাজের সূত্রে তাকে ম্যানহাটনে পাঠানো হয়। সে লোলার খোঁজে যায় এবং অবশেষে তাকে খুঁজে পায়। সে তখন বেশ বড়োলোক আর পরিত্রাণ পেতে আগ্রহী। সে তাকে একশ ডলার দিলে,চলে যায় ডেট্রয়েটে কাজের সন্ধানে।
বারদামু ফোর্ড মোটর কোম্পানির অ্যাসেম্বলি লাইনে নিযুক্ত হয়। বারদামু কাজটাকে ক্লান্তিকর এবং অমানবিক মনে করে। বারদামু মলি নামের বেশ্যার প্রেমে পড়ে। যুবতীটি তাকে তার সাথে আমেরিকায় সংসার করতে বলে কিন্তু বারদামু জড়িয়ে পড়তে চায় না। সে যে পরিস্থিতির মধ্যেই থাকুক না কেন তা থেকে পালানোর চেষ্টা করে । বারদামু ফ্রান্সে ফিরে গিয়ে ডাক্তারির প্রশিক্ষণ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
.
প্যারিসে ফিরে, বারদামু তার ডাক্তারি পড়া শেষ করে এবং লা গারেন-রেন্সির অন্ধকার (কাল্পনিক) উপশহরে ডাক্তারি শুরু করে। বাসিন্দারা বেশিরভাগই খুব গরিব। তাকে ফিস দেবার সামর্থ নেই বললেই চলে। বারদামু অনাকাঙ্খিত গর্ভপাত আর যাদের রোগ সারছে না তাদের চিকিৎসায় গুরুত্ব দেয়। তার রোগীদের মধ্যে রয়েছে মাদাম অঁরুইল আর তার স্বামী যার মা, ঠাকুমা তাদের বাড়ির পিছনে একটি ঝুপড়ির মধ্যে থাকে । তারা বুড়িকে হত্যা করার জন্য রবিনসনকে ভাড়া করে কিন্তু সে তার জন্য যে বারুদের ফাঁদ পাতে তা তার মুখেই ফেটে গিয়ে তাকে অন্ধ করে দেয়।
.
বারদামু প্যারিসের উপকণ্ঠে পাগলাগারদের আশ্রয়ে চাকরি খুঁজে পায়। পাগলাগারদের পরিচালক, ডাক্তার ব্যারিতঁ, বারদামুর থেকে ইংরেজি শেখা নেওয়া শুরু করেন। ব্যারিতঁ মনোচিকিৎসার প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে আর বারদামুকে দায়িত্ব দিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যায়। ব্যারিতঁর চিকিৎসালয়ে বারদামুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে একজন নার্স সোফির সঙ্গে।
.
রবিনসন বারদামুর সাথে দেখা করে বলে যে আর মাদেলঁ ক্রিপ্টে তাদের লাভজনক চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কারণ সে আর মেয়েটার ভালবাসা চায় না। বারদামু তাকে নিজের আশ্রয়ে থাকার অনুমতি আর সামান্য কাজ দেয়। মাদেলঁ রবিনসনকে খুঁজে বের করে আর হুমকি দেয় যে তাকে বিয়ে না করলে পুলিশে ধরিয়ে দেবে । সোফি, পরামর্শ দেয় যে সে, বারদামু, রবিনসন আর মাদেলঁ একসঙ্গে ডাবল ডেটে গেলে ব্যাপারটার সুরাহা হবে। চারজন মিলে একটা কার্নিভালে যায় কিন্তু ট্যাক্সি করে চিকিৎসালয়ে ফেরার সময় রবিনসন মাদেলঁকে বলে যে সে তার সাথে থাকতে চায় না কারণ সে প্রেম ব্যাপারটাকে ঘেন্না করে। তাদের মধ্যে প্রচণ্ড তর্কাতর্কি হয় আর মাদেলঁ রবিনসনকে গুলি করে পালিয়ে যায়। রবিনসন মারা যায়। ঘটনার ফলে বারদামুর মনে হয় যে সে মৃত্যুর চেয়ে বড় কোনো ধারণা খুঁজে পাননি।
.
‘ডেথ অন দ্য ইনস্টলমেন্ট প্ল্যান’ উপন্যাসে ফার্দিনাঁ বারদামু, সেলিনের অল্টার ইগো যা জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট উপন্যাসে আছে, এই উপন্যাসটা তার আগের পর্ব। প্যারিসের একজন ডাক্তার, দুস্হদের চিকিৎসা করে কিন্তু তারা বারদামুকে খুব কমই ফিস দেয় অথচ সমস্ত সুযোগ নেয়। কাহিনি রৈখিক নয় তবে সময়ের সাথে সাথে বারদামু আগের স্মৃতিতে ফিরে যায় আর প্রায়ই কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ায়, বিশেষ করে ফার্দিনাঁর যৌন কর্মকাণ্ডে। শৈলীটা ইচ্ছাকৃতভাবে রুক্ষ । বাক্যগুলো প্রতিদিনের প্যারিসীয় ট্র্যাজেডিকে উপস্হাপন করতে আরও কঠিন হয়ে ওঠে: জীবনযাপনের জন্য সংগ্রাম, অসুস্থতা,যৌনরোগ, পরিবারের দুর্ভাগ্য, মূর্খতা,বিদ্বেষ,লালসা এবং লোভে জর্জরিত নিচের তলার জনসাধারণ।
জীবনের শেষ দশ বছর তিনি প্যারিসের বাইরে, মিউদঁতে ডাক্তারি করে কাটিয়েছিলেন সেলিন, ১৯৬১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত, যখন স্ট্রোকে মারা যান। এই বাড়িতেই বিট আন্দোলনকারী উইলিয়াম বারোজ, অ্যালেন গিন্সবার্গ আর গ্রেগরি কোরসো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
.
ছয়
.
‘জার্নি’, এবং পরবর্তী ‘ডেথ অন দ্য ইন্সটলমেন্ট প্ল্যান’ এর অনুবাদের মাধ্যমে, সেলিন আমেরিকানদের ক্রুদ্ধ বিতৃষ্ণার প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাধারণভাবে উপলব্ধ মান হয়ে ওঠেন। ১৯৫০ এর দশকে ম্যাককার্থি-বিরোধী বুদ্ধিজীবী বিদ্রোহে তিনি একজন পথপ্রদর্শকের জায়গা নিয়ে নেন। ব্যাপারটা বিটনিক আর হিপিদের কাউন্টার কালচার হয়ে মার্কিন সমাজে চলতে থাকে, অতিপপাকৃত উদ্দীপকের মতন, অ্যালেন গিন্সবার্গ প্যারিস রিভিউতে একটি সাক্ষাত্কারে সেলিনের মহত্ত্ব ঘোষণা করেন। জ্যাক কেরুয়াক ‘ডেজোলেশান অ্যাঞ্জেলস’ বইতে স্বীকার করেছেন যে তিনি আংশিকভাবে সেলিনকে অনুকরণ করেছেন। উইলিয়াম বারোজ, সেলিনের একজন স্বঘোষিত প্রশংসক, ‘নেকেড লাঞ্চ’ উপন্যাসে আত্ম-বিদ্বেষের ওগরানিতে সেলিনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেনন, যেমনটা ‘নস্যা’ বইতে সার্ত্র করেছিলেন। এই জোরালো প্রশংসা মার্কিন শহুরে নরকের অধিবাসী ঔপন্যাসিকদের দ্বারা পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। আরও সাধারণভাবে, নতুন অনুবাদ এবং বিদ্যায়তনিক অধ্যয়নসহ সেলিন ইংরেজি ভাষায় শুধুমাত্র পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন না, তবে সর্বনাশের কিম্ভূতকিমাকার ও অপ্রচলিত সাহিত্য সাধনার সাথে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা ব্যাপক হয়ে উঠেছে। ফিরে ফিরে সাহিত্যজগতে আবির্ভূত হন লুই ফার্দিনাঁ সেলিন।
.
সেলিন আর উইলিয়াম বারোজের পারস্পরিক সাক্ষাৎকার ঘটে ১৯৫৮ সালের ৮ জুলাই । বারোজের সঙ্গে ছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ আর গ্রেগরি কোরসো।সেলিম তাঁর তৃতীয় স্ত্রী আর বেশ কয়েকটা কুকুরের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম প্যারিসের শহরতলি মিউদঁতে থাকতেন। সেন নদীর বাঁক আর প্যারিস থেকে দূরে সুদৃশ্য এলাকায় বড়ো দোতলা বাড়িতে থাকতেন। রোগিদের কাছ থেকে তো বিশেষ ফিস পেতেন না । বাড়ি করতে পেরেছিলেন উপন্যাস বিক্রির টাকায়। সাক্ষাৎকারের সময়, যখনই কোনো সমসাময়িক সাহিত্যিকের উল্লেখ করেছিলেন বিট আন্দোলনকারীরা, সেলিন একবাক্যে তাদের নাকচ করে দিচ্ছিলেন। যে লেখকের নামই বারোজ উল্লেখ করেছেন, সেলিন মন্তব্য করেছেন “ওহ, ও কিছুই নয় … প্রতি বছর সাহিত্যের পুকুরে নতুন ছোট মাছ দেখা যায়।জাঁ পল সার্ত্রে কিছুই নয় ! জাঁ জেনে কিছুই নয় !” বারোজ তাঁকে মরফিনের প্রতি নিজের আসক্তি সম্পর্কে বলেছিলেন।অ্যালেন গিন্সবার্গ পরে হাসাহাসি করেছিলেন যে তাঁদের সাহিত্য-নায়ক টের পাননি যে গিন্সবার্গ ইহুদি । সেলিনের সঙ্গে দেখা করার এই অভিযান ছিল অ্যালেন গিন্সবার্গের পরিকল্পনা, যিনি কারও কাছ থেকে সেলিনের ঠিকানা পেয়েছিলেন।
.
বারোজ স্মৃতিকথায় লিখেছেন, আমরা অবশেষে একটা বাস খুঁজে পেলাম যেটা ফরাসি ট্রানজিট দিকনির্দেশের ঝরনার কাছে আমাদের ছেড়ে দেয়। টাউট ড্রয়েট, মেসিউরস, এই শহরতলির আশেপাশে আমরা আধ মাইল হেঁটেছি, শেষে সেলিনের ভিলা খুঁজে পেলাম। ভিলাটা দেখতে অনেকটা লস অ্যাঞ্জেলেসের উপকণ্ঠের ভিলাগুলোর মতন। হঠাৎ কুকুরদের ঘেউ ঘেউ শোনা গেল, বুঝতে পারলাম ঠিক বাড়িতেই পৌঁছেচি। বড়-বড় কুকুর। সেলিন কুকুরদের শান্ত করার জন্য চিৎকার করছিলেন, এবং তারপরে ড্রাইভওয়েতে বেরিয়ে আমাদের ভেতরে আসতে ইশারা করলেন। উনি আমাদের দেখে খুশি হয়েছিলেন এবং স্পষ্টতই আমরা তা বুঝতে পারছিলাম। তাঁকে দেখতে হুবহু একজন পুরানো প্রতিক্রিয়াশীল দারোয়ানের মতন লাগছিল, তাঁর চারপাশে শাল পড়ে, আর তাঁর চারপাশে বেশ কয়েকটি স্কার্ফ ছিল, প্রায় তিন বা চারটি পুরানো স্কার্ফ, এবং সোয়েটার...আর তাঁর চপ্পল পায়ে কয়েক জোড়া মোজা।
.
আমরা দোতলা বিল্ডিংয়ের পিছনে পাকা উঠানে টেবিল ঘিরে বসেছিলাম আর ওনার স্ত্রী, যিনি নাচ শেখাতেন – তাঁর নাচের স্টুডিও ছিল বাড়িটায় - কফি নিয়ে এসেছিলেন। সেলিনকে ঠিক যেমনটি দেখতে আমরা কল্পনা করেছিলাম তিনি সেরকমই। তিনি একটি গাঢ় স্যুট পরেছিলেন, গলায় স্কার্ফ আর গায়ে শাল ছিল, এবং পাঁচ-ছয়টা কুকুর, ভিলার পিছনে একটি বেড়ার জায়গায় বাঁধা ছিল, সময়ে সময়ে ঘেউ ঘেউ চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।
.
বাড়িটা একটা বড় ম্যানসান.. ম্যানসান-ছাদের ব্যক্তিগত বাড়ি, খুব বড় ব্যক্তিগত বাড়ি । নীচে একটি কেন্দ্রীয় করিডোর এবং দুই পাশে বড় ফ্রেঞ্চ-জানালাওয়ালা কক্ষ। অ্যালেন জিজ্ঞাসা করেছিল যে কুকুরগুলো কখনও কাউকে মেরে ফেলেছে কিনা। সেলিন জবাবে বলেছিলেন, “না, আমি শুধু গোলমাল এড়াবার জন্যই রেখেছি।" অ্যালেন তাঁকে কিছু বই, ‘হাউল’ এবং গ্রেগরি করসোর কাব্যগ্রন্হ আর আমার বই জাঙ্কি দিয়েছিল। সেলিনের কোন আগ্রহ দেখা গেল না । উনি বইগুলোর দিকে তাকালেন আর সেগুলো একপাশে রাখলেন। উনি যেভাবে বইগুলো স্পর্শ করেছিলেন এবং তাদের একপাশে রেখেছিলেন তা থেকে বলা যায় যে সেলিন আর কখনও তাদের দিকে তাকাবেন না।
.
স্পষ্টতই তাঁর সময় নষ্ট করার কোনো উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না। সেলিন নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ফরাসি লেখক বলে দাবি করেন, এবং বলেন কেউ তাঁর প্রতি মনোযোগ দেয় না। তবু, এমন কেউ-কেউ আছেন যাঁরা তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করতে চেয়েছিলেন। আমরা কে, বা বিট আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই ছিল না। অ্যালেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে তিনি বেকেট, জেনে, সার্ত্রে, সিমোন দ্য বভোয়া, হেনরি মিশাউ প্রমুখদের সম্পর্কে কী ভাবছেন। তিনি সবাইকে বরখাস্ত করার জন্য তাঁর পাতলা, নীল-শিরাযুক্ত হাত নাড়িয়ে বললেন: “প্রতি বছর সাহিত্যের পুকুরে একটা নতুন মাছ আসে।"ওসব কিছুই নয়, কিছুই নয়, কিছুই নয়”।
.
অ্যালেন জিগ্যেস করে "আপনি কি একজন ভালো ডাক্তার?" সেলিন বলেছিলেন: "আচ্ছা .. আমি…যুক্তিসঙ্গত।” অ্যালেন তারপর জিগ্যেস করে "প্রতিবেশীদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো ?” উনি বলেন, “অবশ্যই না। ইহুদিদের কারণে আমি আমার কুকুরদের গ্রামে নিয়ে যাই। পোস্টমাস্টার আমার চিঠিগুলো নষ্ট করে দেয়। ওষুধের দোকান আমার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ দেয় না…।” ঘেউ ঘেউ করা কুকুরগুলো তাঁর কথায় বিরাম চিহ্ন দিল।
.
গিন্সবার্গ তাঁকে জিগ্যেস করল, "আপনার রোগিরা কেমন আছে? আপনি একটি যুক্তিসঙ্গত জীবনযাপন করতে পারেন?" - জবাবে সেলিন বললেন, "না, আমার কাছে আসা বেশিরভাগই মধ্যবয়সী মহিলা আর তারা কেবল একজন যুবকের সামনে তাদের পোশাক খুলতে চায়। তাহলে তারা কি আমার সামনে তাদের কাপড় খুলে ফেলতে চাইবে?” উনি বললেন, আপনি একটা দেশকে তখনই জানতে পারবেন যখন তার কারাগারের অভিজ্ঞতা হবে ।
.
আমরা সরাসরি সেলিন উপন্যাসে চলে গেলাম। এবং তিনি আমাদের বললেন যে ডেনরা কেমন গুয়ের তৈরি মানুষ । তারপর যুদ্ধের সময় বাইরে পাঠানোর একটি গল্প বললেন। জাহাজটা টর্পেডো করা হয়েছিল এবং যাত্রীরা পাগলের মতন দৌড়োদৌড়ি করছিল তাই সেলিন তাদের সবাইকে লাইন করে এবং তাদের প্রত্যেককে মরফিনের একটি বড় শট দেন যার ফলে তারা সকলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং পুরো নৌকা জুড়ে বমি করে।
.
লুই ফার্দিনাঁ সেলিনের সঙ্গে দেখা করে প্যারিসের বিট হোটেলে ফিরে অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘ইগনু’ শিরোনামে এই কবিতাটা লেখেন। ‘ইগনু’ অভিধা নির্দিষ্ট ধরণের ব্যক্তিকে বর্ণনা করে, যিনি তাঁর অন্যান্য অসংখ্য গুণাবলীর মধ্যে, "শুধুমাত্র একবার এবং অনন্তকাল বেঁচে থাকেন এবং তিনি তা জানেন" এবং "প্রত্যেকের বিছানায় তিনি ঘুমোন ।" গিন্সবার্গ ‘ইগনু’ কবিতায় তাঁর অনেককে ইগনাসের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইগনাস শব্দটি লাতিন যার অর্থ আগুন । সংস্কৃত অগ্নি বলতে যা বোঝায়
.
অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর কবিতা ‘ইগনু’
তার ওপর আপনি যদি আমাকে চেনেন তবে আমি আপনাকে একজন ইগনু ঘোষণা করব
ইগনু পৃথিবীর কিছুই জানে না
কারখানার একজন বিরাট অজ্ঞ, যদিও তিনি হয়তো তার মালিক বা তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন এমনকি উৎপাদন ব্যবস্থাপকও হতে পারেন
ইগনুর দেবদূতের জ্ঞান আছে আসলে ইগনু জোকারের আকারে দেবদূত
ডাবলু সি. ফিল্ডস হার্পো মার্কস ইগনাস হুইটম্যান একজন ইগনু
র্যাঁবো বালকদের প্যান্ট পরে স্বাভাবিক ইগনু
ইগনু অদ্ভুত হতে পারে যদিও দয়ালু ইগনুর মত নয় অদ্ভুত রোমাঞ্চের জন্য দেবদূতদের উড়িয়ে দেয়
একজন জ্ঞানবাদী মহিলা তাকে ভালবাসে অনেক মৃত কাকিমার জন্য খ্রিস্টের কম্পিত বীর্য উপচে পড়ে
সে একজন বড় শিশ্নমানব ইগনুরা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের পূজা করে
হলিউের খুকিদের বা আইডাহোর একা মেরিদের প্রচারকামী ঢ্যাঙাপায়ের মহিলাদের আর গোপন গৃহিণীদের
আরেক জীবনের ইগনুকে চিনতে পেরেছেন আর তাদের প্রেমিকদের মনে রাখে
স্বামীরাও গোপনে তাদের বন্ধু ইগনুর প্রতি কোমল-হৃদয়
পুরানো দিনের বন্ধুত্ব যা ইচ্ছে করতে পারে অসতী-বউয়ের স্বামী লোকটা মাতাল কাঁপছে আর আনন্দে ডগমগ
ইগনু শুধুমাত্র একবার এবং অনন্তকাল বেঁচে থাকে আর সেটা সে জানে
সে সবার বিছানায় ঘুমোয় সবাই ইগনুর জন্য একা কেননা ইগনু আগেই একাকীত্বের কথা জানতো
তাই ইগনু হলো শিশ্নের এবং মনের এক আদিম
একইভাবে ইগনু প্রচুর থাক-থাক ব্যক্তিগত বিমূর্ত অধিবিদ্যা লিখেছেন
প্রতচ্ছবি যা চাঁদকে আঁচড়ে দেয় 'বিদ্যুৎঝলকের-স্ফূলিঙ্গে’' নগ্ন ভোজ ভাজা জুতা বিদায় রাজা
দেবদূতের ছায়া উল্টো দিকে হাত নাড়ছে
বুদ্ধিমত্তার ভোর টেলিফোনগুলোকে অদ্ভুত প্রাণীতে পাল্টে দেয়
সে তার রহস্যময় কাঁচি দিয়ে গোলাপ বাগান ছাঁটাই করে স্নিপ স্নিপ স্নিপ
ইগনু তার নিজের দীর্ঘ বিষাদ দিয়ে পার্ক এভিনিউকে রাঙিয়েছেন
আর ইগনু তার ক্ষয়িষ্ণু ঘরে কালোদের হোটেলে টাকপড়া প্যারিসের শক্ত চেয়ারে বসে হাসছে
ইগনু তার বুনো ন্যাতা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কলোসিয়ামের পাশ দিয়ে হাঁটছে
কিটসের কবর থেকে একটা সপ্তপর্ণী পাতা এবং শেলির থেকে ঘাসের শীস তুলছে
কোলরিজ জানতেন যে তারা লন্ডনে মেহগনি টেবিল ঘিরে মধ্যরাতে ফিসফিস করে আলোচনা করে
পাশের রাস্তার ঘরে শীতকালে বৃষ্টির বাইরে কুয়াশায় ট্যাক্সিচালক তার হাত নাড়ায়
ইগনু হয়ে জন্ম চার্লস ডিকেন্স শিশুর হাহাকার শুনতে পান
ইগনু ব্রিজের নিচে রাত কাটায় এবং যুদ্ধজাহাজ দেখে হাসে
ইগনু উত্তর সাগরে বন্দুকবিহীন একটি যুদ্ধজাহাজ হারিয়েছে হায় মুহুর্তের ফুল
সে ভূগোল জানে যে সে সেখানে ছিল বেরোবার আগে মারা যাবে
আরবীয় শোকপূর্ণ রসিকতার গুনগুন করতে থাকা দাড়িওয়ালা ইহুদি আবার জন্মায়
মানুষ যার কপালে একটা তারা আর তার মাথের পেছনে জ্যোতিচক্র
তার চুলে অমরত্বের চাঁদের আলো পাতার পতনে আনন্দে গান শুনছে
সুফি দরবারে এটেবিল-ওটেবিল করছেন সবথেকে সূক্ষ্ম আচরণের সবচেয়ে মার্জিত কমরেড
তিনি এমনকি সেখানেও ছিলেন না
রাশিচক্রের নীল হাতাজামা আর জাদুকরের লম্বা চূড়াযুক্ত টুপি মাথায়
একটা লাল তারার নীচে মধ্যরাতে একটি কুয়োর নীরবতার সাথে কথা বলেন
রকফেলার সেন্টারের লবিতে প্যান্ট সহ বা ছাড়াই মনোযোগী বিনয়ী খালি চোখ উৎসাহী
জ্যাজ শোনেন যেন তিনি একজন সাদা দেবত্বে আক্রান্ত নিগ্রো ইহুদি বিষণ্ণতায় ভুগছেন
ইগনু লোকটা স্বাভাবিক তুমি তাকে দেখতে পাবে যখন তিনি বিমূর্তভাবে ট্যাক্সির ভাড়া মেটান
অসম্ভব সন্তের পাকানো তাড়া খুলে টাকা দিচ্ছেন
কিংবা তাঁর অদৃশ্য পয়সা গুনছেন সেই অদ্ভুত বাসচালককে দেওয়ার জন্য যার প্রশংসা করেন
ইগনু আপনাকে খুঁজে বের করেছে সে ঈশ্বরের দয়া চায়
আর ঈশ্বর প্রতি দশ বছর তার জন্য পৃথিবীকে ভেঙে দেন
তিনি দিনের প্রকাশ্য আলোয় বিদ্যুৎ চমকাতে দেখেন যখন আকাশ নীল থাকে
তিনি হারলেমের একটি ঘরে ব্লেকের বিচ্ছিন্ন কণ্ঠস্বর সূর্যমুখীর আবৃত্তি শুনতে পান
তাঁর হাতা থেকে সাত লক্ষ পাগল পণ্ডিতে ঘেরা বাদলা পোকারা উড়ে যায়
তিনি অনন্তকালে প্রবেশ করে উন্মাদ বিরতির পর মারা যেতে চান
বেঁচে থাকেন এবং একজন বয়স্ক সাধুকে শেখান বা একটি ভ্রু-জোকারের কাছে ভেঙে পড়েন
সমস্ত ইগনাস এক মুহূর্তের কথাবার্তায় একে অপরকে চিনে নেন আর একে অপর বুঝে ফেলতে পারেন
সারা মহাদেশ জুড়ে আজীবন বন্ধু হিসেবে রোমান্টিক চোখ মেলে খিলখিল হাসেন
দুঃখজনক মুহূর্ত ট্যাক্সিকে বিদায় জানিয়ে শহরের অন্য দিকে দ্রুত চলে যান
দলের মধ্যে এক বা দুজন গোমড়ামুখ ইগনাস
ডাঙ্গারি-পরা একজন হাসিমুখ সন্ন্যাসী
একজন ডিমের কাপে তার ডিম ফাটিয়ে আনন্দে আত্মহারা
একজন সারা রাত ধরে রক অ্যান্ড রোল গানে চিউইঙগাম চিবোয়
পেটেনের অতিবৃষ্টি-অরণ্যে একজন নৃবিজ্ঞানী কোকিল
একজন সারা বছর জেলে বসে কর্মফল ঘোড়দৌড়ের বাজি ধরে
একজন ভৌতিক ফিল্মে ইস্ট ব্রডওয়েতে মেয়েদের তাড়া করে
একজন তার প্যান্ট থেকে শুকনো আঙুর এবং পচা পেঁয়াজ বের করে
একজনের বিছানার নীচে দর্শনার্থীদের আনন্দ দেওয়ার জন্য দুধেল ছাগল রয়েছে বাজে কথা দিয়ে দেয়াল রাঙায়
কাঁকড়াবিছে হুইস্কি আকাশ ইত্যাদি যোগাড় করে পারলে সে চাঁদও চুরি করবে
আমেরিকায় তা আগুন লাগিয়ে দেবে কিন্তু এগুলোর কোনোটাই ইগনু তৈরি করবে না
আত্মাই সেই জিনিস যা শৈলীকে তার চিন্তার কোমল আতশবাজি করে তোলে
পুরানো বন্ধুদের কাছে অদ্ভুত শহর থেকে চিঠির সৌহাদ্র্য
আর বিদেশী বিছানায় সকালের নতুন দীপ্তি
ব্যক্তিগত হওয়ার কমেডি তার গর্বিত দেবত্ব
এলিয়ট সম্ভবত ইগনুদের মধ্যে এমন একজন যিনি খাবার সময় মজা করেন
প্যাটারসনের উইলিয়ামস মারা যাচ্ছেন এমন একজন আমেরিকান ইগনু
বারোজ একজন বিশুদ্ধ ইগনু তার চুল কাটার ক্রিম তার বাম আঙ্গুল
প্রাথমিক বার্ধক্যজনিত কারণে কেটে ফেলা হয়েছে আধিভৌতিক বানান মনোবিশ্লেষণের সাথে প্রেমের মন্ত্র
তার নেশাখোর জীবন এক মিলিয়ন ডলার দামের চেয়ে বড়ো কৃতিত্ব
সেলিন নিজেই গদ্যের একজন পুরানো ইগনু
আমি তাঁকে প্যারিসে দেখেছি নোংরা বুড়ো ভদ্রলোক
লম্বা চুলের কাশি সহ তাঁর গলায় তিনটি মোটা সোয়েটার
ঐতিহাসিক নখের নীচে বাদামী ছাঁচ
বিশুদ্ধ প্রতিভা একটি ডুবন্ত জাহাজের ১৪০০ যাত্রীকে সারারাত মরফিন দিয়েছিলেন
''কারণ তারা সবাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল'
কে আশ্চর্যজনক আপনি ইগনু আমার সাথে যোগাযোগ করুন
বার্তা পাঠান পোস্ট টেলিগ্রাফ ফোন রাস্তায় অভিযোগ করে বা আমার জানালায় আঁচড় কেটে
আর আমাকে একটা খাঁটি সংকেত পাঠান আমি বিশেষ ডেলিভারিতে উত্তর দেব
মৃত্যু এমন একটি চিঠি যা কখনো পাঠানো হয়নি
জ্ঞানের জন্ম ডাকটিকিট শব্দ মুদ্রা সঙ্গম জেল ঋতু মধুর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নাইট্রাস অক্সাইডে
উজ্জ্বল জানালায় একটি স্বর্গীয় দিন আঁকা সমুদ্রের সোনার আলোর আলোকচিত্রের ইতিহাস
কালো মেঘের মধ্যে একটি চোখ
এবং তুর্কি বাসের জানালা থেকে দেখা যায় বালিয়াড়িতে একা শকুন
এটা নিশ্চয়ই একটা কৌশল । হাতে দুটি হীরা একটি কবিতা একটি দানছত্র
প্রমাণ করে আমরা স্বপ্ন দেখেছি এবং বুদ্ধিমত্তার দীর্ঘ তলোয়ার
যার জন্য আমি ছয় বছর বয়স থেকে আমার প্যান্টের মতো ক্রমাগত হোঁচট খাচ্ছি -- বিব্রত হয়ে।
.
সাত
.
১৯৭৪ সালে লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে , বিট আন্দোলনের লেখক উইলিয়াম বারোজকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, তিনি লুই-ফার্দিনাঁ সিলিন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন কিনা। বারোজ বলেছিলেন, , "হ্যাঁ, হয়েছি”। প্যারিস রিভিউ-এর সাক্ষাৎকারে বারোজ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, “আমি সেলিনের ‘জার্নি টু দ্য এন্ড অফ দ্য নাইট’ (১৯৩২ ) এবং ‘ডেথ অন দি ইনস্টলমেন্ট প্ল্যান’ (১৯৩৬) উপন্যাসের ভাষাশৈলী মার্কিনি ঢঙে প্রয়োগ করেছি ‘নেকেড লাঞ্চ’ ( ১৯৫৯) উপন্যাসে। বারোজ বলেছেন, “আমি নিজেকে পিকারেস্ক ঐতিহ্যে স্থান দিই, টমাস নাস-এর ‘দ্য ফরচুনেট ট্র্যাভেলার’ ( ১৫৯৮ ) থেকে শুরু করে, পেট্রোনিয়াস-এর ‘স্যাটিরিকন’, এবং অবশ্যই, লুই-ফার্দিনাঁ সেলিন-এর ‘জার্নি টু দ্য এণ্ড অব দি নাইট’ পর্যন্ত। ।
.
পিকারেস্ক ঐতিহ্যে, এক বা একাধিক নায়কের সত্যিকার বা কাল্পনিক যত্রতত্র যাত্রার খাতিরে এগোয়, আর মুখোমুখি হয় দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারের বা বিপজ্জনক পথগমনের, শেষেরটাই বেশি ঘটে । একটি পিকারেস্ক আখ্যান সাধারণত আত্মজীবনীমূলক বিবরণ হিসাবে উত্তমপুরুষে লেখা হয়। প্রধান চরিত্রটি প্রায়শই নিম্নবর্গের বা সামাজিক শ্রেণীর হয়। তারা বুদ্ধিমত্তার সাথে এগিয়ে যায় এবং খুব কমই একই চাকরিতে বা পেশায় আটক থাকে। সামান্য প্লট থাকে বা ছোটো-ছোটো ভিনিয়েট জুড়ে এগোয়। গল্পটা আলগাভাবে সংযুক্ত অ্যাডভেঞ্চার বা তার একটা শৃঙ্খলায় বলা হয়।
.
এই জনারের উপন্যাস প্রথমে স্পেনে লেখা আরম্ভ হয়েছিল (স্পেনীয়:"পিকারেস্কো" অর্থাৎ"দুর্বৃত্ত", বা "বদমাশ" ) । তারপর ১৭ এবং ১৮ শতকের ইউরোপে বিকাশ লাভ করেছিল। জনারটি এখনও আধুনিক সাহিত্যকে প্রভাবিত করে চলেছে। শব্দটি সাধারণত ব্যঙ্গাত্মক গদ্য কথাসাহিত্যের একটি উপশৈলীকে নির্দেশ করে এবং বাস্তবসম্মত, প্রায়শই হাস্যকর বিশদ বর্ণনা করে । ‘লাজারিলো ডি টর্মেস’, ১৫৫৪ সালে এন্টওয়ার্প এবং স্পেনে বেনামে প্রকাশিত প্রথম পিকারেস্ক উপন্যাস । প্রধান চরিত্র লাজারিলো একজন দুর্বৃত্ত যে তার বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে ভন্ডামীতে ভরা এক গরিব দেশে বসবাস করে । ইংরেজি-ভাষী বিশ্বে, ‘পিকারেস্ক’ শব্দটি স্প্যানিশরা যে সুনির্দিষ্ট ধারাকে চিহ্ণিত করেছিল, তার চেয়ে বেশি একটি সাহিত্যিক কৌশল বা মডেল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে । ইংরেজি-ভাষায় অভিধাটি মূলত একজন প্রতিনায়কের দুঃসাহসিক কিংবা সমাজ-বহির্ভূত ঘটনার বয়ান খাড়া করে।
.
বারোজের জন্ম ১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিত্তশালী পরিবারে। তাঁর প্রথম বই ‘জাঙ্কি : কনফেশানস অব অ্যান আনরিডিমড ড্রাগ অ্যাডিক্ট’ (১৯৫৩)। তাঁর উপন্যাস ‘নেকেড লাঞ্চ’ (১৯৫৯) সম্পর্কে আলোচক রবার্ট লোয়েল বলেছেন যে ‘এটা খুবই শক্তিশালি এবং গুরুত্বপূর্ণ বই। গদ্য এবং কবিতার যে কোনো ভাল বইয়ের পাশাপাশি এর জায়গা, এবং এমন জীবন্ত বই বহু বছর পর একজন আমেরিকান লিখলেন।’ বারোজের অন্যান্য বইগুলো-দ্য একস্টারমিনেটর (ব্রায়ান জিসিনের সঙ্গে, ১৯৬০), দ্য সফটমেশিন (১৯৬১), দ্য টিকিট দ্যাট এক্সপ্লোডেড (১৯৬২), দ্য ইয়েগ লেটারস (অ্যালান গিনসবার্গ-এর সঙ্গে, ১৯৬৩) এবং নোভা এক্সপ্রেস (১৯৬৪)। বারোজ আঠারোটি উপন্যাস ও নভেলা লিখেছেন, ছয়টি ছোটগল্পের সংকলন এবং চারটি প্রবন্ধের সংকলন, এবং তাঁর সাক্ষাৎকার ও চিঠিপত্রের পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে; তিনি প্রথমদিকে উইলিয়াম লি নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি অসংখ্য অভিনয়শিল্পী এবং সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে কাজ করেছেন এবং রেকর্ডিংয়ে সহযোগিতা করেছেন, চলচ্চিত্রে উপস্থিত থেকেছেন এবং তাঁর "শটগান আর্ট" সহ অজস্র ভিজ্যুয়াল আর্টওয়ার্ক তৈরি ও প্রদর্শন করেছেন।
.
বিশের দশকের গোড়ার দিকে থেকে উইলিয়াম বারোজ নিয়মিত হেরোইন, কোকেন, মেথাডিন, পিয়োটি, অ্যাম্ফিটেমাইন আর গাঁজার মতন মাদক নেয়া আরম্ভ করেন। যখন বারোজ তাঁর ‘নেকড লাঞ্চ’ উপন্যাসের নায়কের মতো সঠিক মাদক পাননি, তিনি পোকা মারার স্প্রে দিয়ে ইনজেকশন নিয়েছিলেন, আর কারখানার অ্যালকোহল পান করতেন। এমন মনে করার কারণ নেই যে বারোজ একটি অসুখী শৈশব থেকে পালিয়ে যেতে চাইছিলেন। লুই ফার্দিনাঁ সেলিন থেকে একেবারে আলাদা ছিল তাঁর জীবন। তিনি ১৯১৪ সালে একটি বিত্তশালী সেন্ট লুই পরিবারে জন্মেছিলেন, যে প্রাসাদে ছিল তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ চাকর, একজন আইরিশ বাবুর্চি এবং একজন ওয়েলশ আয়া। পরের দুজন দৃশ্যত যুবকটির মাথায় অতিপ্রাকৃতের এমন বিশ্বাসযোগ্য গল্প ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে বারোজ বড়ো হয়েও সেগুলো বিশ্বাস করতেন। বৈভবশালী বারোজ পরিবার, যারা ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ থেকে দিব্বি বেঁচে গিয়েছিল, উইলিয়াম বা বিল বারোজ ছিলেন সেই পরিবারের উত্তরাধিকারী। তরুণ বিলকে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বোর্ডিং প্রতিষ্ঠান, সেন্ট আলামোস স্কুল, নিউ মেক্সিকোতে ভর্তি করা হয়েছিল।
.
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পর বারোজের সঙ্গে নিউইয়র্কে জ্যাক কেরুয়াক, অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং পরে নিল ক্যাসাডির সাথে পরিচয় হয় । তার আগে তিনি ইউরোপ সফর করেন।তাঁরা চারজনই লেখক হতে চাইছিলেন। যখন ১৯৫৭ সালে কেরুয়াকের ‘অন দি রোড, প্রথম প্রকাশিত হলো তখন তাদের গোষ্ঠী "বিট জেনারেশন" নামে পরিচিত হয়ে ওঠে, যা ক্লাসিক সাহিত্যের মতো জ্যাজ ছন্দ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। উভকামী, হেডোনিস্টিক, কম ভাড়া এবং আত্মাভিমানী বিটরা, ১৯৫০ এর দশকে একজন আমেরিকান সাহিত্যিক বলতে যা বোঝায় তার ছাঁচ ভেঙে ফেলতে পেরেছিল।
.
বারোজের সমস্ত প্রাথমিক সাহিত্য পরীক্ষাগুলো অবশ্য নজর কাড়তে পারেনি। তিনি মেক্সিকোতে চলে যান যেখানে হেরোইন সহজে পাওয়া যেতো । মেক্সিকো সিটিতে এক রাতে মাতাল অবস্হায় গুলি ছোঁড়ার টিপের দক্ষতা দেখাবার সময় বারোজ তাঁর আশ্চর্যজনক সহনশীল স্ত্রী জোয়ান ভলমারকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। বারোজ পরিবার দামি আইনজীবী নিয়োগ করেছিল আর বিলকে দুই সপ্তাহেরও কম জেলে থাকার পর মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তবু তিনি বিচারের সাজা এবং শীতল কারাগারের বিছানা সম্পর্কে কয়েকটি অভিযোগ দর্জ করেছিলেন । ছাড়া পেয়ে বারোজ প্রথমে নিউইয়র্কে আর তারপর ট্যানজিয়ারে চলে যান । সেই সময়ে বারোজ দাবি করেন যে এক "কুৎসিত আত্মা" জোয়ানকে হত্যা করতে বাধ্য করেছিল আর সেই কুৎসিত আত্মা থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা হিসাবে আন্তরিকভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন।’জাঙ্কি ‘ বইটা প্রথমে পেপারব্যাক সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল যা ১৫০০০০ কপি বিক্রি হয়েছিল।’দ্য নেকেড লাঞ্চ’ লেখেন তার পরেই, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ অনুসরণ করে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোস্ট অফিস বইটাকে অশ্লীল ঘোষণা করলে বারোজ মার্কিন কাউন্টার কালচারে নিজের জায়গা নিশ্চিত করে ফেলতে পারেন। ‘নেকেড লাঞ্চ’ উইলিয়াম লি-এর দুঃসাহসিক কাজ, বা দুঃসাহসিক কাজগুলোকে অনুসরণ করে, যে লোকটা বারোজের প্রতিরূপ, যে নিউ ইয়র্ক শহর থেকে বিভিন্ন মার্কিন গন্তব্যস্থল হয়ে মেক্সিকো, ট্যানজিয়ার্স আর ইন্টারজোনের একটা সাই-ফাই সংস্করণ ভ্রমণ করে, এই কারণে যে ট্যানজিয়ার্স ১৯২৩ সালে ইন্টারজোন ছিল।
.
বারোজ লিখেছেন, “আমি আতঙ্কজনক নির্ণয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি যে আমি কখনই লেখক হতে পারতাম না যদি না ওইভাবে জোয়ানের মৃত্যু হতো, এবং এই ঘটনাটি আমার লেখাকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছে তা উপলব্ধি করার জন্য লেখা জরুরি হয়ে উঠেছিল। আমি কুৎসিত আত্মার হুমকির সাথে বাস করি, এবং তার দখল থেকে, নিয়ন্ত্রণ থেকে পালানোর একটি ধ্রুবক প্রয়োজন। জোয়ানের মৃত্যু আমাকে আক্রমণকারী, কুৎসিত আত্মার সংস্পর্শে এনেছিল এবং আমাকে একটি দীর্ঘ জীবন সংগ্রামের মধ্যে চালিত করেছিল, যেখানে আমার লেখা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
.
বারোজ প্রচলিত উপন্যাসের কাঠামোর সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, “এরকম কাঠামো বাস্তবতাকে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়। ওগুলো নির্বিচারে কাঠামো। ওগুলোর মৌলিক বনেদ হল একটা শুরু, একটা মধ্য এবং শেষ, একজন সর্বজ্ঞ লেখক যিনি জানেন যে তার চরিত্রগুলো কী ভাবছে আর কী ঘটতে চলেছে, আর তারপরে অমন পরিকল্পনা অনুযায়ী অধ্যায়গুলো গড়ে তোলেন৷ এই ধরনের নির্মাণের হুকুমে চললে, প্রতিটি অধ্যায় সম্পর্কে আপনাকে প্রত্যাশায় নিমজ্জিত থাকতে হবে, সাসপেন্স তৈরি করতে হবে। প্রথম অধ্যায়ে যা ঘটছিল তাতে তৃতীয় অধ্যায়ে ফিরে আসার আগে মস্তিষ্ক আপনাকে পরবর্তী অধ্যায়টি চালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। স্পষ্টতই, বাস্তবে এমনটি ঘটে না। এটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম ।"
.
যদিও প্রচুর পরীক্ষামূলক এবং অবিশ্বস্ত কথকদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত, বারোজের বেশিরভাগ কাজ আধা-আত্মজীবনীমূলক, এবং প্রায়শই হেরোইন আসক্ত হিসাবে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে নিয়েছেন।ব্রায়ন জিসিনের সাথে, বারোজ কাট-আপ নামে এক শৈলীকে জনপ্রিয় করে তোলেন, এটি একটি স্বল্পমেয়াদী সাহিত্যিক কৌশল, যা ‘নোভা ট্রিলজি’ (১৯৬১-১৯৬৪) এর মতো কাজগুলিতে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করেছেন। বারোজের রচনায় রহস্য, জাদুবিদ্যা বা অন্যথায় যাদুকরী থিমগুলোও আছে, যা তাঁর জন্য একটি ধ্রুবক ব্যস্ততা ছিল, কথাসাহিত্য এবং বাস্তব জীবন, উভয় ক্ষেত্রেই ।
.
‘নেকেড লাঞ্চ’ এবং এর তিনটি পরিশিষ্ট, ‘দ্য সফট মেশিন’, ‘নোভা এক্সপ্রেস’ এবং ‘দ্য টিকিট দ্যাট এক্সপ্লোড’-এ, বারোজ মানুষের লোভ, দুর্নীতি এবং অবজ্ঞার একটি জটিল এবং ভয়ঙ্কর রূপক বুনেছেন। অ্যালডাস হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ (১৯৩২) এবং জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর ( ১৯৪৯ )-এর মতো, বারোজের এই চারটে উপন্যাস একটা নির্দিষ্ট ধরণের মন্দের বা মন্দের প্রবণতাকে বর্ণনা করে - যা বারোজ সমসাময়িক বিশ্বে বিশেষভাবে ক্ষতিকারক বলে মনে করেন - আর তাদের উপস্হাপন করেন এক ডিসটোপিয় ভবিষ্যতে, যেখানে, তারা রাক্ষস হয়ে ওঠে এবং একটি অতিরঞ্জিত এবং ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে।
..
.
১৯৯৭ সালে ‘দি গার্জিয়ান’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে উইলিয়াম বারোজ বলেছিলেন, “আমার জীবনে একমাত্র ব্রায়ন জিসিনকে আমি শ্রদ্ধা করি । আমি অনেকের সম্পর্কে উচ্চধারণা পোষণ করি, অনেককে পছন্দ করি, কিন্তু উনি একমাত্র মানুষ যাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি।” তার আগে ১৯৬৬ সালে ‘দি প্যারিস রিভিউ’ পত্রিকায় কনর্যাড নিকারবকারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বারোজ বলেছিলেন, “ ব্রায়ন জিসিন নামে এক বন্ধু, মার্কিন কবি ও পেইনটার, যিনি ৩০ বছর ইউরোপে ছিলেন, আমি যতোদূর জানি, তিনিই প্রথম কাট-আপ টেকনিক প্রয়োগ করেছিলেন । তাঁর কাট-আপ কবিতা ‘মিনিটস টু গো’ বিবিসি থেকে প্রসারিত হয়েছিল, এবং সেটি তিনি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করেছিলেন । এই টেকনিকের সম্ভাবনা সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মায়, এবং আমি নিজেও তা নিয়ে নিরীক্ষা আরম্ভ করি । অবশ্য আপনি যদি ‘দি ওয়েস্ট ল্যাণ্ড’ এর কথা ভাবেন, সেটি ছিল প্রথম বিখ্যাত কাট-আপ-কোলাঝ, এবং ত্রিস্তঁ জারাও একই লাইনে কিছু কাজ করে গেছেন । একই আইডিয়া ডস প্যাসস ‘ইউএসএ’-র ‘দি ক্যামেরা আই’ তে প্রয়োগ করেছিলেন । আমার মনে হয়েছিল যে আমিও সেই একই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছি । যখন নিজের সামনে টেকনিকটা প্রয়োগ করতে দেখলুম, তখন তা ছিল আমার কাছে এক বিস্ময়কর রহস্যোদ্ঘাটন।”
.
উইলিয়াম বারোজের বিখ্যাত বইগুলো, যেমন ‘নেকেড লাঞ্চ’ ( ১৯৫৯, প্রথম সংস্করণে কাট-আপ করা হয়েছে ), ‘দি সফ্ট মেশিন’ ( ১৯৬১, প্রথম সংস্করণে কাট আপ করা হয়েছে ), ‘দি টিকেট দ্যাট এক্সপ্লোডেড’ ( ১৯৬২, প্রথম সংস্করণে কাট-আপ করা হয়েছে ) এবং ‘নোভা এক্সপ্রেস’ ( ১৯৬৪, প্রথম সংস্করণে কাট-আপ করা হয়েছে ) কাট-আপ টেকনিক প্রয়োগ করে লেখা। কাট-আপ পদ্ধতিকে উইলিয়াম বারোজ বলেছেন তা হল সাহিত্যে আণবিক বোমার আবিষ্কার । ‘দ্য নেকেড লাঞ্চ’ এবং অন্যান্য উপন্যাসে, উইলিয়াম এস বারোজ, প্লট এবং সুসঙ্গত চরিত্রায়ন পরিত্যাগ করে, একটি ভয়ঙ্কর আধুনিক ল্যান্ডস্কেপ চিত্রিত করতে একজন মাদকাসক্তের চেতনা ব্যবহার করেছেন।
.
১৯৫৯ সালে ব্রায়ন জিসিন একদিন বিট হোটেলে নিজের ড্রইঙ নিয়ে কাজ করার সময়ে আকস্মিকভাবে কাট-আপ টেকনিক আবিষ্কার করেন । তাঁর নিজের কথায়,”ছবি আঁকার জন্য, এক তাড়া সংবাদপত্রের ওপরে রাখা, একটা বোর্ডের চারপাশ ধারালো ছুরি দিয়ে কাটছিলুম, আর মনে হল, ছয় মাস আগে বারোজকে যা বলেছিলুম, যে ছবি আঁকার টেকনিককে লেখালিখিতেও সরাসরি প্রয়োগ করতে হবে, তা স্পষ্ট হয়ে গেল। আমি সংবাদপত্রের কেটে-ফেলা সদ্যপ্রসূত শব্দগুলো এলোমেলো সাজিয়ে একেবারে আলাদা একটা টেক্সট তৈরি করে ফেললুম, যা পরে প্রথম কাট-আপ হিসাবে আমার ‘মিনিটস টু গো’ ( ১৯৬০ ) কাব্যগ্রন্হে প্রকাশিত হয়েছে ।” ‘মিনিটস টু গো’ কবিতায় কোনো সম্পাদনা ও পরিবর্তন করা হয়নি, কাগজের ফালি সাজানোর পর শব্দগুলো যেমনভাবে সেজে উঠেছে, হুবহু তেমন করেই প্রকাশ করা হয়েছিল । ‘মিনিটস টু গো’ প্রকাশের পরে জিসিন কাঁচি-কাটা শব্দের পারমুটেশান কম্বিনেশান নিয়ে খেলেছেন ।
.
উইলিয়াম বারোজ সেসময়ে তাঁর ‘নেকেড লাঞ্চ’ বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করছিলেন, তাতে প্রয়োগ করলেন ব্রায়ান জিসিন আবিষ্কৃত কাট-আপ পদ্ধতি, এবং মার্কিন সাহিত্য জগতে তা হুলুস্হুল ফেলে দিল । তাঁর, বারোজের, পাণ্ডুলিপিতে কাট-আপ প্রয়োগ করার সময়ে জিসিন ও বারোজ দুজনে মিলে প্রয়োজনমতো সম্পাদনা ও পরিবর্তন করেছিলেন । বারোজের ‘নোভা ট্রিলজি’তেও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন, কিন্তু খেয়াল রেখেছেন যাতে তা অত্যন্ত দুর্বোধ্য ও অর্থহীন হয়ে না যায় । এই পদ্ধতি প্রয়োগের দরুন ভাষাকে আক্রমণ করে টেক্সটে অন্তর্ঘাত ঘটানো ও রৈখিকতা ভাঙার সুবিধা হয়ে গেল কবি ও লেখকদের ।
.
যে নতুন গদ্য বা কবিতা কাট-আপ করে গড়ে ওঠে, জিসিন বলেছেন, তার শব্দেরা নিজস্ব নৃত্যভঙ্গিমা নিয়ে জেগে ওঠে, অর্থময়তার ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে বাক্যের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে প্রতিধ্বনি হয়ে, অথচ পুরোনো গদ্য বা কবিতায় এই ক্ষমতা তাদের ছিল না । জিসিন আরও বললেন, কবিদের কাজ হল শব্দদের মুক্তি দেয়া, আত্মনির্ভরশীলতা দেয়া । ভাবপ্রকাশের শব্দসমষ্টিতে শব্দদের শৃঙ্খলিত করা কবিদের কাজ নয় । কে বলেছে কবিদের কাজ চিন্তা করা ? কবিদের কাজ হল শব্দদের বুকে যে গান ভরা আছে সেগুলো তাদের গাইতে দেয়া । কবিদের “শব্দের মালিকানা” হয় না, “কোনো কবির নিজস্ব শব্দবন্ধ হয় না । কবে থেকে শব্দেরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে উঠল ?”
.
জিসিন বললেন, কাট-আপ পদ্ধতি কবি-লেখকদের এনে দিয়েছে ধ্বনি ও দৃশ্যের কোলাজ, যে পদ্ধতি ছবি-আঁকিয়েরা বহুকাল ব্যবহার করছেন, ঠিক তাই ; একই পদ্ধতি দেখা যায় মুভি ক্যামরা বা স্টিল ক্যামেরায় তোলা ফোটোয় । পথে তোলা ফোটোগুলোতে পাওয়া যাবে অপ্রত্যাশিত পথচারীদের, তারা আকস্মিকভাবে দৃশ্যের ফ্রেমে কাট-আপ শব্দের মতন দেখা দেয় । খ্যাতনামা ফোটোগ্রাফাররা জানেন যে সবচেয়ে ভালো ফোটোগুলো আকস্মিকভাবে তোলা ; একই কথা বলবেন কবি-লেখকরা, যাকে অনেকে বলেন প্রেরণা । আকস্মিকতা ও তাৎক্ষণিকতা ভেবেচিন্তে হয় না, তা আপনা থেকে উদয় হয়, কাট-আপে পাওয়া অর্থময়তার ঢেউদের মতন, একখানা কাঁচির সাহায্যে । ব্রায়ান জিসিনের আলোচক মারিনা ক্যাশডান বলেছেন যে, বর্তমান যুগের কাট-আপ হল টুইটার ফিডগুলো । কাশডান বলেছেন যে জিসিন “সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থেকে চেতনাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।”
.
আট
.
সেলিন এবং বারোজের বহু ব্যাপারে মিল আছে । তাঁদের সৃজনশীলতার কেন্দ্রীয় গুরুত্ব হলো লেখা এবং শিল্পের মধ্যে জরুরি সম্পর্ক । সেলিন বিশ্বাস করেন যে ঠিক যেমন কিছু চিত্রশিল্পী, যেমন, ভ্যান গগ, বাস্তবজগতের বস্তুদের ক্যানভাসে ‘স্হানান্তর’ করেন, তাঁর উপন্যাসও তেমনই কথ্য ভাষার আবেগকে লিখিত আকারে "স্থানান্তর" করে পৃষ্ঠায় উপস্থাপনা করা হয়। এঁদের উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্যে প্যারানয়া আর বিভ্রমের উপস্হিতি স্পষ্ট এবং তা যে সাহিত্যের খাতিরে তাঁরা লেখায় এনেছেন, তা নয় । তাঁদের মস্তিষ্ক ওই ভাবেই কাজ করে । প্যারনোয়া একটি তীব্র উদ্বেগ বা ভীতিকর অনুভূতি এবং প্রায়ই তা নিপীড়ন, হুমকি বা ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত । প্যারানয়া মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির সাথে ঘটতে পারে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মানসিক ব্যাধি । অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা এবং বিশ্বাসগুলো দৃঢ় হয়ে গেলে প্যারানয়েড চিন্তাভাবনাগুলি বিভ্রান্তিতে পরিণত হতে পারে । তখন একজন লোক বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে যে তারা যা ভাবে বা অনুভব করে তা সত্য । কারণ শুধুমাত্র চিন্তাভাবনা প্রভাবিত হয়, ভ্রমজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে কাজ চালিয়ে যায় , তবে, তাদের বিভ্রমের ফলে তাদের জীবন সীমিত এবং বিচ্ছিন্ন হতে পারে। ইহুদিবিদ্বেষের কারণে সেলিন এবং দ্বিতীয় স্ত্রীকে হত্যা করার পর ‘কুৎসিত আত্মা’র খপ্পরে উইলিয়াম বারোজ মুক্ত হতে পারেননি প্যারানয়া আর বিভ্রম থেকে। বারোজ বলেছেন যে ‘নেকেড লাঞ্চ’ যেখান থেকে ইচ্ছা পড়া যায় ; যেখান থেকে পাঠক পড়বেন, সেখান থেকেই শুরু।
.
দুজনেই মিসানথ্রোপ, অর্থাৎ তাঁরা মানুষের চেয়ে প্রাণীদের সাথে বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করতেন, বিড়াল পছন্দ করতেন।সেলিন অন্যদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ এড়িয়ে চলতেন এবং একাকীত্ব খুঁজতেন। বারোজ বিপরীতভাবে, বহিরাগত এবং সমাজের প্রতি নিজের অসন্তোষ প্রকাশ্যে প্রকাশ করে গেছেন।সেলিন এবং বারোজ দুজনেই প্যারানইয়া এবং মিসানথ্রোপে ভরা অন্ধকার জগতের দৃশ্য উপস্হাপন করেছেন। এটি আইকনোক্লাস্টিক হতাশাবাদের মতো ব্যাপার । সেলিন লিখেছেন, "মৃত মানুষ জীবিত মানুষের চেয়ে কম ভীতিকর"। বারোজের রচনায় এই উক্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে যখন তিনি বলেছেন যে "অসুস্থ ব্যক্তিরা ভালোদের তুলনায় কম ভীতিকর" । উভয়ই উদ্ভাবনী সাহিত্য কৌশলের সাহায্যে তাঁদের হতাশাকে সমাজ-সংসারের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন।শেষ পর্যন্ত, বারোজ এবং সেলিন উভয়ই নৈতিকতাবাদী ছিলেন, তাদের পরীক্ষামূলক শৈলী এবং প্রদাহজনক গদ্য বিংশ শতাব্দীর অযৌক্তিক সন্ত্রাসের সাথে মোকাবিলা করার উপায় হয়ে ওঠে। নোংরা রাজনীতি সত্ত্বেও, সেলিন মানবতার নৈতিক অধঃপতন এবং নৈতিক আপেক্ষিকতার একটি অবিচ্ছিন্ন ঘটনাক্রম তৈরি করে গেছেন।
.
বারোজ আদি আমেরিকানদের ‘ফ্রন্টিয়ার ব্যক্তিত্ববাদে’ বিশ্বাস করতেন, যাকে তিনি বলতেন, আপনার নিজের চরকায় তেল দিন যা আমেরিকার গৌরবময় সীমান্ত ঐতিহ্য। আমলাতান্ত্রিক অত্যাচারকে উদারতাবাদের সমতুল্য মনে করতেন তিনি। সরকারী কর্তৃত্বকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব করার আইন প্রণয়নকারী হস্তক্ষেপের সমষ্টি হিসাবে দেখতেন। তাঁর জীবনীকার টেড মরগানের মতে, জীবন যাপনের জন্য বারোজের দর্শন ছিল একটি অবাস্তব পথকে মেনে চলা, যা হবে বাধাবন্ধনহীন - মূলত পুঁজিবাদী ব্যবসায়িক বিশ্বের সাথে মিলে যায় বারোজের মতাদর্শ।
.
বরোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’ থেকে কবিতার আকারে লেখা এই গদ্যটা তুলে দিচ্ছি:-
.
“আমি কি তোমাদের সেই লোকটার কথা বলেছি
যে নিজের পোঁদকে কথা বলতে শিখিয়েছিল ?
ওর পুরো তলপেট ওপর-নীচে নাচতো,
বুঝলে, পেদে-পেদে বাক্যদের বের করতো ।
জীবনে এমন ঘটনা শুনিনি কখনও ।
বুদবুদময়, ভরাট, স্হির শব্দ ।
এমন শব্দ যার গন্ধ তুমি শুঁকতে পারবে ।
সেই লোকটা কার্নিভালে কাজ করতো, বুঝলে কিনা ?
আর যদি বলতে হয় তাহলে সেটা ছিল
একধরনের নবীন ভেন্ট্রিলোকিস্ট কারবার ।
কিছুকাল পর
পোঁদটা নিজের মনেই কথা বলতে শুরু করলো ।
কোনোরকম তৈরি না হয়েই
লোকটা মঞ্চে উঠে পড়তো..…
আর পোঁদটা ওর দিকেই চটজলদি
ঠাট্টা-ইয়ার্কিগুলো প্রত্যেকবার ছুঁড়ে মারতো ।
তারপর তাতে দাঁতের মতন কিছু গজালো…
সামান্য বেঁকা রসালো বঁড়শি
আর খাওয়া আরম্ভ করে দিলো ।
ও প্রথমে ভাবলো ব্যাপারটা বেশ মস্তির
আর তার চারিধারে কাজ গড়ে তুললো…
কিন্তু পোঁদটা ওর ট্রাউজার খেতে-খেতে
রাস্তাতেই কথা বলা আরম্ভ করে দিলে…
চেঁচিয়ে বলতে লাগলো : ও সমান অধিকার চায় ।
ওটা মাতাল হয়ে উঠতো, অনেক সময়ে, আর হেঁচকি তুলে কাঁদতো।
কেউই তা পছন্দ করতো না ।
আর ও চাইতো ওকে চুমু খাওয়া হোক
অন্য যে কোনও মুখের মতন ।
শেষ পর্যন্ত, ওটা সবসময় বকবক করতো,
দিন আর রাত ।
অনেকগুলো বাড়ি পেরিয়েও তুমি শুনতে পাবে ওকে,
পোঁদকে চুপ করার জন্য হুকুম দিচ্ছে চেঁচিয়ে…
ঘুষি পাকিয়ে ওটাকে থাবড়াচ্ছে…
মোমবাতি ঢোকাচ্ছে, কিন্তু…
কোনও ভালো ফল হতো না,
আর পোঁদটা ওকে বলল…
“শেষ পর্যন্ত, আমাকে নয়
চুপ করতে হবে তোমাকেই…
“কেননা আমরা তোমাকে
এখানে আর চাই না ।
আমি একই সঙ্গে কথা বলতে আর হাগতে চাই না ।”
তারপর থেকে, স্বচ্ছ জেলি বের করে
সকালে জেগে ওঠা আরম্ভ করল…
সারা মুখ জুড়ে গজানো
ব্যাঙাচির লেজের মতন ।
সেগুলো মুখ থেকে উপড়ে তুলতে লাগলো ও
আর টুকরোগুলো হাতে আটকে রইলো…
পেটরলের জ্বলন্ত জেলির মতন
আর বেড়ে উঠতে লাগলো ।
ফলে, শেষ পর্যন্ত, ওর মুখ বন্ধ হয়ে গেলো…
আর পুরো মাথা…
যেন আপনা থেকেই খসে পড়বে
চোখগুলো ছাড়া, বুঝলে কিনা ?
একমাত্র ব্যাপার ছিল যে
পোঁদটার দেখার ক্ষমতা ছিল না ।
ওর দরকার ছিল দুটো চোখ ।
শিরার সঙ্গে যোগাযোগ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল…
আর সেঁদিয়ে গিয়েছিল আর অবসন্ন হয়ে গিয়েছিল ।
ফলে, মস্তিষ্ক আর
নির্দেশ দিতে পারতো না ।
ওটা মগজের ফাঁদে আটকে পড়েছিল…
সিলবন্ধ করা ।
পরে, তুমি দেখতে পাবে…
চোখের পেছনে মগজের
নিরব, অসহায় যন্ত্রণা ।
আর তারপর শেষকালে
মগজ হয়তো মরে গেলো..
কেননা চোখ দুটো বেরিয়ে এলো…
ডাঁটির ডগায় কাঁকড়ার চোখের মতন
তাতে আর কোনও অনুভূতি ছিল না ।”
.
পিকারেস্ক উপন্যাসের চরিত্রদের মতন মিসানথ্রোপ এই কারণে দুঃখিত হয় যে তার নিজেরও একই মানবিক ত্রুটি রয়েছে।এই ধরনের একজন ব্যক্তির নৈতিক প্রয়োজনীয়তা এত বেশি যে, ভালো এবং ন্যায়বিচার সম্পর্কে তার বোঝার মান অনুসারে, পৃথিবীতে বসবাসকারী অধিকাংশ লোকই বদমাশ । এই ব্যক্তিরা অন্যদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলে, কর্মক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আচরণ করে, কর্মজীবনের সিঁড়িতে উঠে যায়, কিন্তু একই সময়ে তারা অন্যদের প্রতি তাদের ঘৃণা এবং অবজ্ঞা প্রকাশ করতে পারে। তারা অনুগত বন্ধু হতে পারে, কিন্তু সাবধানে তাদের চারপাশ থেকে ছেঁকে নিয়ে নৈকট্য গড়ে তোলে। দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার এবং ফ্রেডরিখ নিটশেও মিসানথ্রোপ হিসাবে বিখ্যাত। শোপেনহাওয়ার এমনকি সবার প্রতি অবিশ্বাসের আহ্বান জানিয়ে একটি ইশতেহার তৈরি করেছিলেন, কখনও অন্যদের কাছে খুব বেশি কিছু না বলতে, এমনকি সেরা বন্ধুদের কাছ থেকেও গোপন রাখতে বলেছিলেন। ফ্রিডরিখ নিটশে সুপারম্যানের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন, যাঁর সুপারম্যান সাধারণ ব্যক্তির থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে ‘ঈশ্বর মৃত’।
.
সেলিন এবং বারোজ দুজনেই যৌনতা এবং অশ্লীলতার উচ্ছৃঙ্খল বর্ণনার বৈশিষ্ট্যযুক্ত । তাঁদের উপন্যাসগুলো নতুন সাহিত্যিক নজির তৈরি করে হবু সাহিত্যিকদের আকর্ষণ করে। আধা-আত্মজীবনীমূলক উত্তমপুরুষে লেখা আখ্যান। তাঁদের কুড়োনো অপবাদ আর পরাবাস্তব চিত্রের ব্যবহার সমসাময়িক জনপ্রিয় বাস্তববাদী শৈলীর সাথে বিরোধপূর্ণ ছিল এবং তাঁরা শীঘ্রই কুখ্যাতি অর্জনের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁদের প্রাথমিক প্রশংসা সত্ত্বেও, জার্নি এবং নেকেড লাঞ্চ মূলধারার পাঠকদের তুলনায় অন্যান্য লেখকদের উপর বেশি প্রভাব ফেলেছে। বারোজের গদ্য তুলনামূলকভাবে ‘কঠিন’ কিন্তু সেলিনের ‘ব্ল্যাক হিউমারের’ ও সেলিনের প্রতিভার কারণে ‘জার্নি’ ব্যতিক্রমী। প্রকৃতপক্ষে, অস্পষ্ট আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, যেটিকে সেলিন এবং বারোজ জনপ্রিয় করেছিলেন, সাহিত্যে তার পুনরুত্থান দেখা গেছে ডব্লিউ জি সেবাল্ড, এনরিক ভিলা-মাটাস, পল অস্টার এবং ইয়ান সিনক্লেয়ারের কাজের মাধ্যমে । এর কারণ পাওয়া যায় বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোঝার ক্ষেত্রে ভাষার ভূমিকার উপর সেলিনে আর বারোজের সাহিত্য-বক্তব্য । তাঁদের অত্যন্ত ব্যক্তিগত কাজগুলো যে ইঙ্গিত করে তা হল যে জীবন এবং কল্পকাহিনী উভয়ের অভিজ্ঞতাই কেবল শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে, এবং সেই হিসাবে, দুটি একই বুদ্ধিবৃত্তিক স্থান ভাগ করে নেয়; একটি দার্শনিক ধারণা যা মার্সেল প্রুস্ত এবং টমাস ডি কুইন্সি যুক্তিযুক্তভাবে সাহিত্যে প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু যেখানে প্রুস্ত এই মানবিক অভিজ্ঞতাকে রোমান্টিসাইজ করেছিলেন এবং ডি কুইন্সি তাঁর স্বপ্নের মতো আফিম দর্শনে সত্যের সন্ধান করেছিলেন, সেলিন এবং বারোজ সত্য এবং কল্পকাহিনীর মধ্যে পার্থক্যের এই অস্পষ্টতাকে একটি দুঃস্বপ্ন হিসাবে উপস্থাপন করেছেন, তাই ‘জার্নি’ আর ‘নেকেড লাঞ্চ’ উপন্যাসে পাওয়া যায় চূড়ান্ত নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। যাইহোক, তা করতে গিয়ে তাঁরা উপন্যাসের একটি নতুন ধারণারও পথপ্রদর্শক; ক্ষয়কর ও শ্লেষাত্মক ভাষায় লেখা, যা জেমস জয়েস ‘ইউলিসিস’-এ বাস্তববাদী উপন্যাসের কাঠামো ভেঙে ফেলে শুরু করেছিলেন।
কনরাড নিকারবোকারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বারোজ জানিয়েছেন, “১৯৫০ নাগাদ আমি লিখতে শুরু করি; সে সময় আমার পঁয়ত্রিশ বছর বয়স ছিল; কোনো দারুণ কিছু প্রেরণা ছিল বলে মনে হয় না। আমি সহজভাবে চেষ্টা করছিলাম সাংবাদিকতার ছকে সোজাসুজি নেশা আর নেশাড়িদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা লেখার।আমার কিছু করার ছিল না। রোজ আমাকে কিছু একটা করতে সাহায্য করছিল এই লেখালেখি। অভাবনিয় কিছু একটা ফল হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। ‘জাংকি’ আসলে তেমন কিছু একটা বই নয়। সে সময় লেখালেখির ব্যাপারে আমি কমই জানতাম। মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই আমি থাকতাম সিয়ার্স, রোবাক-এ। আমি চার পাঁচ মাস সেনাবাহিনিতে ছিলাম তখন জি.আই. বিল-এ সেখানে স্থানিয় অধিবাসিদের আঞ্চলিক ভাষা পড়ছি। আমার মেক্সিকোতে যাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল আমেরিকায় নেশার ব্যাপারে প্রচণ্ড ঘোঁট পাকানো একটা অবস্থা। মেক্সিকোতে নেশার বস্তু সহজলভ্য ছিল, তাই আমাকে ছুটে বেড়াতে হত না, আর পুলিশের চাপও ছিল না। ভাগ্যক্রমে অস্থির অবস্থা ছাড়াই আমি বেশিরভাগ দৃষ্টি বিভ্রমকারি ড্রাগ নিয়ে দেখেছি। এলএসডি-২৫ আমার কাছে মেসকালিন নেওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। সমস্ত দৃষ্টিবিভ্রমকারি ড্রাগের মতোই এলএসডি আমাকে বর্ধিত সচেতনতা দিয়েছে, সত্যি বিভ্রম বদলে দিয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রম। আপনি দরজার একটা গোল হাতলের দিকে তাকিয়ে থাকলে দেখবেন তা বৃত্তাকারে ঘুরছে, যদিও আপনি এব্যাপারে সচেতন যে এটা ঘটছে ড্রাগটা নেওয়ার জন্য। এছাড়াও ভ্যানগগিয় রঙ, ওইসব ঘূর্ণিসমেত আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চড়চড় শব্দ।”
.
বারোজ সেলিনের বাক্য গঠন শৈলীর এলিপসিস ( উপবৃত্ত ) প্রচুর ব্যবহার করেছেন।অ্যানি টোনার ইংরেজি সাহিত্যে Ellipsis-এর প্রয়োগ সম্পর্কে বলেছেন: “এলিপসিস হলো বাদ দেবার শৈলী : “অসমাপ্ত বাক্যের একটি শক্তিশালী অকল্পনীয় শক্তি থাকতে পারে। বলা যায় যে তাদের সম্পূর্ণরূপে খুলে ফেলার বদলে অতিরিক্ত মানসিক শক্তি তৈরি করে।” বারোজ aposiopesis ( নীরবতা )সহ এলিপসিস ব্যবহার করেছেন: পাঠকদের কল্পনাকে উসকে দেবার জন্য , বিশেষ করে বিষম চিন্তা-ভাবনা উদ্রেক করার জন্য। সেলিনই প্রথম নন যিনি উপন্যাসে এলিপসিস প্রয়োগ করেছেন। সেলিনের আগেও উপবৃত্তকে নিখুঁত হাতিয়ার মনে করা হয়েছে কেননা আমরা কীভাবে চিন্তা করি এবং কথা বলি সে সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রকাশ করার জন্য এলিপসিসের প্রয়োগ জরুরি । ইংল্যাণ্ডে ১৮ শতকের শেষের দিকে, ট্যাবলয়েড এবং জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোতে উপবৃত্তের প্রয়োগ এতই সর্বব্যাপী ছিল যে জেন অস্টেন তাঁর প্রথম দিকের কাজগুলোতে উপবৃত্তকে উপহাস করেছিলেন এবং জর্জ এলিয়ট তাঁর বইগুলো থেকে সেগুলো কেটে বাদ দিয়েছিলেন: উপবৃত্তের ইতিহাস সম্পর্কে বইতে জানিয়েছেন অ্যান টোনার ।
.
অসমাপ্ত সংলাপ বা বাক্যের শেষে তিনটে ফুটকি বা ডট, যার দ্বারা এলিপসিস গড়ে ওঠে তা ইউরোপের আধুনিকতাবাদী লেখকরা অনেকেই ব্যবহার করেছেন, তবে সেলিন এবং বারোজ ব্যবহার করেছেন অনেক বেশি। জেমস জয়েস, স্যামুয়েল বেকেট এবং টি.এস.এলিয়ট-এর কাজে প্রায়শই উপবৃত্তগুলো পাওয়া যায়। আধুনিকতাবাদীদের মধ্যে ভার্জিনিয়া উলফ-এর মতো উপবৃত্তকে বোধহয় আর কেউ অতো পছন্দ করেননি, যাঁকে তিনটি ছোট বিন্দু এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, এক পর্যায়ে, তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাসের শিরোনাম রাখতে চেয়েছিলেন "দ্য … ভয়েজ আউট।"
.
এলিপসিস বা উপবৃত্তের ফুটকিগুলো বিভ্রান্তি, নিরাপত্তাহীনতা, যন্ত্রণা, বা অনিশ্চয়তার সঙ্গে অলস বা খণ্ডিত কথাবার্তা নির্দেশ করে; বারোজের ক্ষেত্রে যেমন একজন মাদকাসক্তের অথবা কাট-আপ প্রক্রিয়ায় তৈরি বাক্যে। সেলিনের উপন্যাসে উপবৃত্তের সবচেয়ে সাধারণ ব্যবহার হল ট্রেলিং অফ (প্রযুক্তিগত শব্দ: অ্যাপোসিওপেসিস) নির্দেশ করা এবং উত্তেজনা তৈরি করা। তাছাড়া উপবৃত্তটির দুই দিকের শব্দ/বাক্য বিশেষ চিন্তার নির্দেশ করে। কিংবা সেলিন যখন চরিত্রের সংলাপে দ্বিধা দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেছেন তখন প্রয়োগ করেছেন।অনেক সময়ে তিনটে ফুটকির কাজ হলো দেখানো যে একটি চরিত্র ভয়ে কান্নাকাটি বা তোতলানোর সময় কথা বলার চেষ্টা করছে।
.
সেলিনের এলিপসিস বা উপবৃত্তগুলো মিশ্রিত উদ্বেগ, আকস্মিক আঘাত, হতাশা এবং ক্লান্তির বার্তা পৌঁছে দেয় পাঠকের সংবেদে এবং তা এমনই যে এখনকার দিনে পাঠক সম্ভবত দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্য ( post traumatic stress disorder ) হিসাবে নির্ণয় করবে। (সেলিন নিজেই তাঁর লেখার শৈলীকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পাওয়া আঘাতের ফল হিসেবে দায়ী করেছেন।) তাঁর গদ্যের শৈলীতে লেখক এবং পাঠকের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার প্রায় অসহনীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার অনুভূতিও রয়েছে — সেলিন বলেছিলেন "আমার আগ্রহের বিষয় হলো পাঠকের স্নায়ুতন্ত্রে সরাসরি বার্তা পৌঁছে দেয়া ।" সেলিনের গদ্যে হাড়, পেশী, তরুণাস্থি কেটে ফেলা হয়েছে — যা বাকি আছে তা হল রক্ত এবং মজ্জা।
.
সেলিনের তিনটে ফুটকিসহ গদ্য —-
.
১) ““অঢেল গুদ, পেট, বাঁড়া, উঁচুনাক আর মাছি তুমি জানো না তাদের নিয়ে কী করবে... ... কিন্তু হৃদয়? ... খুব দুর্লভ! গত পাঁচশ কোটি বছরে অনেক মোরগ এবং গ্যাস্ট্রিক টিউব গুনতে হবে... কিন্তু হৃদয়? ... আপনার আঙুলে কুলিয়ে যাবে…!”
.
২)“কাছাকাছি … এবং কাছাকাছি … তারা খুব শীঘ্রই সেতুতে আঘাত করবে … সর্বোপরি … এই ধরনের অযোগ্যতা টিকে থাকার জন্য খুব ভাল ছিল … কিন্তু পুরো দলটা বেশ দ্বিধায় ছিল … এখানে একটা সামান্য ব্যাখ্যা রয়েছে … ম্যাডাম রেমুসাত আর তাঁর মেয়ে…. আঁচিলের মধ্যে শুয়ে আছে, তাদের পেট গোবরে সমতল… তীরে… একটি বোমার গর্ত… তারা ড্যান্ডেলিয়ন বাছাই করতে আসবে… তারা সবাই কাদা দিয়ে ঢেকে গেছে ! … একটা পুরু স্তর … তারা নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে, ভয় পেয়েছে … তারা নড়ছে না … মরে গেছে নাকি? হতে পারে. যাইহোক, তাদের পেট সমতল ছিল … আমি তাদের সম্পর্কে আর কখনও শুনিনি … তারা শহরের অন্য প্রান্তে থাকত …”
.
সেলিন বলেছেন তিনটে ফুটকির কাজ হলো: ১ ) কমা এবং পূর্ণচ্ছেদের স্বাভাবিক বিরাম চিহ্নের পরিবর্তে বিরতি হিসাবে কাজ করা; ২ ) পৃষ্ঠায় একটি চিহ্ন হিসাবে পরিবেশন করা যাতে উপস্থাপিত হওয়া চেতনার প্রবাহের রৈখিক, প্রকৃতির বিপরীতে খণ্ডিত ভাবনাকে তুলে ধরা যায় ; এবং ৩ ) লেখা তৈরি করার জন্য তার প্রোগ্রাম কার্যকর করা যা "সঠিক স্নায়ুতন্ত্রকে উসকে দিতে সফল হয়”।
.
’কনভারসেশানস উইথ প্রফেসর ওয়াই’ গ্রন্হে সেলিন তাঁর শৈলীর সমর্থনে বলেছেন যে উপবৃত্তের মাত্রাধিক ব্যবহার এবং তার বিচ্ছিন্ন বাক্যগুলি লিখিত ভাষায় মানুষের আবেগকে মূর্ত করার এক প্রচেষ্টা। সেলিন সাহিত্যকে কাগজের ওপরে মানুষের আবেগের মানচিত্র আঁকার শিল্প হিসাবে দেখেছিলেন। এই ধরনের মানচিত্র স্বাভাবিক থেকে আলাদা, এবং এটি আবেগকে বিকৃত করে। তিনি একে জলেভরা টবে আংশিকভাবে নিমজ্জিত একটা সোজা ফুটরুলের দিকে তাকানোর সাথে তুলনা করেছেন। আলোর প্রতিসরণের কারণে আপনি ফুটরুলকে দেখেন যেন এটি ভেঙে গেছে। যদি আপনার লক্ষ্য হয় যে অমন অবস্হায় একটা সোজা ফুটরুলের যতটা সম্ভব নির্ভুল ছবি দেখার, তাহলে ফুটরুলটাকে জলে ডুবিয়ে দেওয়ার আগে আপনাকে সেটাকে এমনভাবে বেঁকিয়ে নিতে হবে যাতে প্রতিসরণের পরে সেটা সোজা দেখায়। আপনি যদি কাগজের টুকরোতে মানুষের আবেগকে যতটা সম্ভব সঠিকভাবে প্রকাশ করতে চান, তাহলে পৃষ্ঠায় সেগুলি বর্ণনা করার আগে আপনাকে অবশ্যই সেগুলিকে "বেঁকতে" হবে৷ সেলিনের মতে, আবেগকে বেঁকানোর হাতিয়ার হল শৈলী।
.
সেলিনের ‘কনভারসেশানস উইথ প্রফেসার ওয়াই’ বইতে এই বিষয়ে এই সংলাপ আছে —
""ঠিক আছে !...আমার তিনটি বিন্দু ! লোকে কি কখনও তাদের জন্য আমাকে তিরস্কার করেছে ! তারা আমার তিনটি বিন্দু নিয়ে কটূক্তি করেছে !...'আহ ! ওর তিনটি বিন্দু !...আহ, ওর তিনটি বিন্দু !... সে তার বাক্য শেষ করতে পারে না !' বইয়ের প্রতিটি বোকামি ! প্রত্যেকটি, কর্নেল!"
"তাই?"
"যাও! ছরররররর ! ছরররররর !...মোতো গিয়ে, কর্নেল ! আর তোমার মতামত কি, কর্নেল?"
"এই তিনটে বিন্দুর বদলে, আপনি হয়তো কয়েকটা শব্দে লিখতে পারেন, আমি যা অনুভব করি তাই লিখি !"
বারোজের গদ্য বাংলায় অনুবাদ করা কঠিন । মূল গদ্যই তুলে দিচ্ছি এখানে । গদ্যের এই অংশে বারোজ বারোটা এলিপসিস বা উপবৃত্ত ব্যবহার করেছেন।কয়েকটিতে aposiopesis ( কথার মাঝখানে চুপ করে যাওয়া ) ব্যবহার করেছেন যাতে সেই অংশের গুরুত্ব পাঠককে আকৃষ্ট করে।
.
Probing for a vein in the junk-sick morning …Strictly from cough syrup …
A thousand junkies storm the crystal spine clinics, cook down the Grey Ladies …
In the limestone cave met a man with Medusa’s head in a hat box and said, ‘Be careful,’ to the Customs Inspector … Freeze forever hand an inch from false bottom …
Window dressers scream through the station, beat the cashiers with the fairy hype … (The Hype is a short change con … Also known as The Bill …) ‘Multiple fracture,’ said the big physician … ‘I'm Very technical …’
Conspicuous consumption is rampant in the porticos slippery with Koch spit …
The centipede nuzzles the iron door rusted to thin black paper by the
urine of a million fairies …
This is no rich mother load, but vitiate dust, second run cottons trace the bones of a fix …
.
নয়
.
সেলিন মারা যান মিউদঁতে, ১৯৬১ সালে । অপপ্রচার হতে পারে এই ভয়ে তাঁর স্ত্রী কোনো সংবাদসংস্হাকে সেলিনের মৃত্যর খবর দেননি । ১৯৬৮ সালে বাড়িটায় আগুন ধরে যায়, বা কেউ আগুন লাগিয়ে দেয়, যার দরুন সেলিনের সংগ্রহের সমস্ত কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যায়।
বারোজ লরেন্স, কানসাসে ২ আগস্ট ১৯৯৭ সালে মারা যান। তার আগের দিন তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনবার তাঁর হার্টের শল্যচিকিৎসা হয়েছিল ।